দ্বীনকে জীবনের উদ্দেশ্য হিসেবে গ্রহণ করার মাঝে জীবনের সাফল্য নিহিত

শহীদ ইলিয়াসের শাহাদাতের হৃদয়বিদারক ঘটনা ইসলামী আন্দোলনের ত্যাগ ও কুরবানির এক প্রেরণাদায়ক ইতিহাস


১৯৭০ সালের জানুয়ারি মাস, পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্র সংঘের প্রাদেশিক কনফারেন্সের ঘোষণা দেওয়া হয়। প্রায় তিন হাজার ডেলিগেট ও মেহমানের খাবারের দায়িত্ব আমার উপর ছিল। কিন্তু সময়ের আগে খাবার প্রস্তুত করতে পারিনি। সে সময়ে ইলিয়াস এসে জিজ্ঞাসা করলেন, খাওয়া প্রস্তুত হয়নি কেন? আমি বললাম, ধারণার চেয়ে অনেক বেশি লোক চলে এসেছে। বললেন, আমি ব্যবস্থা করছি। তিনি বেশ ভালো স্বাস্থ্য ও শরীরের অধিকারী ছিলেন। বললাম, "শুধু শরীর থাকলেই হবে না, দক্ষতা লাগবে এ কাজে।" তিনি জবাব দিলেন এভাবে, "দশ জনের কাজ একাই করবো, হবে না কেন?" এরপর তিনি কাজে ডুব দিলেন। দ্বিতীয় দিন পল্টন ময়দানে মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীর (রহ.) বক্তৃতা ছিল। কিন্তু আওয়ামী গুন্ডাবাহিনী সভা পণ্ড করে দেয়। আমাদের কয়েকজন লোক জখম হয়। শহীদ হয় কয়েকজন। আহতদের মধ্যে ইলিয়াস ছিলেন।

 
১৯৭০ সালের নির্বাচন আসতে আসতেই তিনি যেন দিওয়ানা হয়ে গ্রামে ছুটে গেলেন। যাতে এই নির্বাচনে ইসলামী শক্তিকে বিজয়ী করতে পারেন। এই লক্ষ্যে তিনি দিনরাত পরিশ্রম করেন। কিন্তু নির্বাচনের ফলাফল যখন এলো, সবাই তখন ভেঙে পড়েছেন। তবে ইলিয়াসের কপালে তখনিও চিন্তার ছাপ পড়েনি। তার এই কথার উপর বিশ্বাস ছিল যে -

"ইয়ে বাজি ইশক কি বাজি হ্যায়, জো চাহো লাগা দো, ডর ক্যা?
গর জিত গায়ে তো ক্যা কেহনা! হারে ভি তো বাজিমাত নাহি"
 
এই প্রেমের খেলায় যা মন চায় সব বাজি লাগাও। জিতে গেলে তো কথাই নেই। তবে হারলে? বাজিমাত হলো না শুধু।
 
অন্যদিকে বাতিল শক্তি চরম উদ্বিগ্ন ছিল শহীদ ইলিয়াসের কর্মতৎপরতায়। তাগুত সব সময় এমন মানুষদের অপেক্ষায় থাকে। সুযোগ পেলেই আঘাত করে। একইভাবে তারা ইসলামী আদর্শের প্রতিনিধি মেধাবী ও স্বাধীনচেতা মোহাম্মদ ইলিয়াসকে ফাঁসাতে নানা জাল বিছাতে শুরু করে। কিন্তু সতর্ক ইলিয়াস প্রত্যেকবার সে জাল ছিন্ন করতেন। এতে দুশমনের বুকে প্রতিহিংসার আগুন আরও বেশি জ্বলে উঠত। ১৯৭১ সালে ফেনীর পরিস্থিতি অনেক বেশি খারাপ ছিল। ভারতীয় ফৌজ প্রথম দিকেই যেসব এলাকা কব্জা করে, তার মধ্যে ফেনী অন্যতম। মার্চে যখন আওয়ামী গুণ্ডারা দেশপ্রেমিক মুসলমানদের রক্তে হোলি খেলা শুরু করে, তখনই সোৎসাহে ইলিয়াসের বাসায় হাজির হয় তারা। কিন্তু ছাত্র সংঘের কর্মীদের অনুরোধে তিনি কিছু দিনের জন্য কুমিল্লা চলে গিয়েছিলেন।
 
পরে ১০ এপ্রিল ফেনীতে ফেরার পথে পাক সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন নাইমের সাথে তার দেখা হয়। নাইম তাকে নিয়ে কুমিল্লায় সেনা ছাউনি যান। ওখানে ফেনীর এসডিএমও উপস্থিত ছিলেন। মুক্তি বাহিনীর গেরিলা যুদ্ধ এবং প্রবাসী সরকারের ব্যাপারে ইলিয়াসের প্রবল ভিন্নমত লক্ষ্য করেন তারা। ছাত্র সংঘের সহযোগিতাও চাইলেন। আলোচনা শেষে ইলিয়াস ঢাকায় চলে যান। ছাত্র সংঘের দায়িত্বশীলদের সাথে এ নিয়ে আলাপ করেন। মোহাম্মদ ইলিয়াস জরুরি প্রশিক্ষণের পর ফেনীর আল বদর কমান্ডার ঘোষিত হন। এই দুর্জয় সাহসেই তিনি অনেক দুঃসাহসী দায়িত্ব পালন করেন। তার নেতৃত্বে আল বদর স্বেচ্ছাসেবীরা ভারতের মাটিতে গোরিলা অভিযান চালিয়ে শত্রুকে গুরুতর আঘাত দিয়ে ফিরে আসে।
 
এসব তৎপরতার কারণে ইসলামের এই সাহসী সন্তানের রক্তপিপাসু ছিল মুক্তিবাহিনী। ৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় যখন ভারতীয় আর্মি ফেনীতে প্রবেশ করে, আল বদরের স্থানীয় নেতৃত্ব তখন সিদ্ধান্ত নেয় দ্রুতই ইলিয়াসকে একটি চর এলাকায় পাঠানোর। কিন্তু ইলিয়াস তা মানতে পারেননি। তিনি বলছিলেন, "আমার উপর আপনাদের দায়িত্ব রয়েছে। আপনাদের ছেড়ে আমি চলে যাব, এটা কিভাবে সম্ভব! বাঁচলে এক সাথেই বাঁচব, আর মরলেও এক সাথে।" কিন্তু তার সাথীদের অনুরোধ ছিল, "আপনার জীবন আমাদের চেয়ে অনেক দামি।"
 
অবশেষে তিনি রাজি হলেন। তবে নির্ধারিত এলাকায় গেলেন না। আব্দুর রহমান নামে এক সাথীকে সঙ্গে নিয়ে পার্শ্ববর্তী এক গ্রামের দিকে রওনা হলেন। রাস্তা ছেড়ে খেতখামার হয়ে আশ্রয়ের খোঁজে যেতে যেতে এশার সময় হয়ে গেল। ওই এলাকার একটি ডাক বাংলো অতিক্রম করার সময় কিছু অস্ত্রধারী তাদের ঘিরে ফেলে। দু’জনের কাছ থেকে একশ একশ করে টাকা ছিল। সাথে ইলিয়াসের দামি ঘড়ি। সব ছিনতাই করে নেয় তারা। পরে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। ইলিয়াস এশা নামাজের অনুমতি চাইলেন। আব্দুর রহমান বর্ণনা করেন, “নামাজের সময় তারা বলাবলি করছিল যে, "ফেনীর ইলিয়াসকে পাওয়া যাচ্ছে না। সে ধরা পড়লেই আমরা বুঝতে পারব ফেনী আমাদের দখলে আছে।"
 
নামাজ শেষ হতেই তাদের উদ্ধত অস্ত্রের মতোই আমরা আল্লাহর দরবার হাত তুললাম। যিনি হাইয়্যু ও কাইয়ুম। জীবন ও মৃত্যু যার অধীনে। নামাজ থেকে ফারেগ হতেই আবারও সওয়াল-জবাব শুরু হলো। এরই মধ্যে এদের সাথে নতুন করে মুক্তিবাহিনীর আরও কয়েকজন সদস্য যোগ দিল। যাদের মধ্যে একজন ইলিয়াসকে চিনে ফেলে। যার রক্তের তৃষ্ণায় তারা হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তার সন্ধান পেয়েছে জেনেই তারা আনন্দে লাফিয়ে ওঠে।” মুক্তি বাহিনী আব্দুর রহমানকে নয় বছর বয়সী এক ছেলের দায়িত্বে দিয়ে ইলিয়াসকে মারধর শুরু করে। আর নিজেদের হিংস্রতা চরিতার্থ করতে নতুন পদ্ধতির চিন্তা করে। 
 
তারা ইলিয়াসকে ট্রাকের পিছনে বেঁধে ফেলে ট্রাক স্টার্ট দেয়। দ্রুতবেগে এভাবেই টেনে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। তার রক্ত মাখা শরীরের জায়গায় জায়গায় গোশত ছিঁড়ে যায়। ট্রাক ফেনী পৌঁছানোর আগেই ইলিয়াস শাহাদাতের পেয়ালা পান করেছেন। চলে গেছেন তার চির আকাঙ্ক্ষিত মঞ্জিলের পানে। এরপরও জালিমদের মনে দয়া হয়নি। তার পিঠে জ্বলন্ত সিগারেট দিয়ে 'জয় বাংলা' লেখা হয়। রাহে হকের এই মহান সেনাপতির শরীর অনেক আগেই অবিনশ্বর আল্লাহ তায়ালার কাছে সোপর্দ হয়ে গেছিল, কিন্তু শত্রুদের বুকের উৎকট আগুন তখনও শান্ত হয়নি। এক সন্ত্রাসী সামনে এসে শহীদ ইলিয়াসের দুটি চোখ তুলে নিয়ে তার লাশ বৈদ্যুতিক খুটিতে ঝুলিয়ে দেয়। চার দিন পর্যন্ত এভাবেই ঝুলে থাকে লাশ। ভয় ও ত্রাসের এক অবর্ণনীয় দৃশ্যের সূচনা করেছিল এই ঘটনা। অবশেষে কিছু বয়োবৃদ্ধ মানুষের অনুরোধে লাশ নামানোর অনুমতি মিলে।
 
শহীদ মোহাম্মদ ইলিয়াস নোয়াখালী জেলার ফেনী মহকুমার রামপুর গ্রামে ১৯৪৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবেই বাবা হাজি নওয়াজ আলী পাটওয়ারী ইন্তেকাল করেন। মা আছিয়া খাতুন অনেক স্নেহে ছোট ছেলেকে লালন-পালন করেন। বাবার পরিবার স্বচ্ছল হওয়ায় অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে পড়তে হয়নি। বরং শৈশব থেকেই ডানা মেলতে শেখেন তিনি। কুর‌আন কারীম শেখার পর বিশেষ যোগ্যতা পরীক্ষা দিয়ে তিনি মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৭০ সালে ফেনী কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে এন্ট্রান্স পাশ করেন। পরে সেখানে বি.এ. ক্লাসে ভর্তি হন। ইন্টার পড়াকালে ইসলামী ছাত্র সংঘের কর্মীদের সাথে সম্পর্ক ও যোগাযোগ তৈরি হয় ইলিয়াসের। এর প্রভাবেই তার জীবনের মোড় ঘুরে যায় ইসলামী আন্দোলনের দিকে।
 
কিন্তু বড় ভাই মুজিবুর রহমান ছিলেন স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা। তিনি ইলিয়াসকে ছাত্র সংঘের সাথে মিশতে কড়া নিষেধ করেন। কিন্তু ইলিয়াস ততদিনে বুঝে শুনেই এই আন্দোলনে শামিল হয়েছেন। সেখান থেকে পিছপা হয়ে ফিরে যেতে তিনি অস্বীকার করেন। ফলে ক্রুদ্ধ হয়ে বড় ভাই তাকে খালি হাতেই বাড়ি থেকে বের করে দেন। এই নিষ্ঠুর সিদ্ধান্তও ইলিয়াসকে থামাতে পারেনি। তিনি বাবার এক বন্ধুর কাছ থেকে মাত্র ১৪শ টাকা ধার নিয়ে পরবর্তী জীবন শুরু করেন। সব সময় চকচকে পোশাক পরা ইলিয়াস এখন সামান্য কাপড়ে আগের তুলনায় আরও অধিক জযবার সাথে মঞ্জিলের দিকে ছুটে চললেন। এই দুঃসময়েই তিনি ইসলামী ছাত্র সংঘের ফেনী শহরের সভাপতি নির্বাচিত হন। তার দুঃসাহসিকতা ফেনীর রাজনীতিতে বিপ্লবের আভাস দেয়। যার কারণে যুদ্ধের আগেই তাকে বারবার থামানোর পরিকল্পনা করে বাতিল শক্তি। 
 
আব্দুল মালেকের শাহাদাতের পর খুব দ্রুতই ইলিয়াস ঢাকায় পৌঁছান। কিন্তু ওখানে গিয়ে দেখেন মাইয়েত তার গ্রামে রওনা দিয়েছে। তিনি কিছুক্ষণ নীরব থেকে থেমে থেমে বলতে লাগলেন, "এখানে সাক্ষাৎ হলো না। ঠিক আছে। তার বাড়িতে গিয়েই দেখা করব।" শহীদ মালেকের গ্রামে গিয়ে খুব ধৈর্য্যের সাথেই জানাযায় অংশ নিলেন তিনি। কিন্তু কবরে মাটি দেওয়ার সময় এমনভাবে ভেঙে পড়লেন যে তাকে সান্তনা দেওয়ার মতো ক্ষমতা কারও ছিল না। আব্দুল মালেকের শাহাদাত তার মধ্যে যেন বিদ্যুৎ সঞ্চার করে। সকল কাজ আগেভাগে করে নিতেন। এভাবে সব সময় নিজেকে ব্যস্ত রাখতেন আন্দোলনের কাজে। — শামসুল হক 
 
ফেনীর শহীদ ইলিয়াসের আলোচনা ছাড়া পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্র সংঘের ইতিহাস অপূর্ণ রয়ে যাবে। তার শাহাদাতের হৃদয়বিদারক ঘটনা ইসলামী আন্দোলনের ত্যাগ ও কুরবানির এক প্রেরণাদায়ক ইতিহাস। __ সালিম মানিসুর খালিদের আল বদর বই থেকে অনূদিত।
Share:

জামায়াত কি স্বজাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল?

 চিত্র:Bangladesh Jamaat-e-Islami Emblem.svg - উইকিপিডিয়া

জামায়াত কি স্বজাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল?
উত্তর হলো, না। ১৯৭১ সালের যে যুদ্ধ তাতে জামায়াত অংশ নিয়েছিল বটে। কিন্তু স্বজাতির বিরুদ্ধে না। কারণ কোন 'স্বজাতি' এখানে যুদ্ধে শামিল হয় নাই। শামিল হইছিল 'স্বজাতি'র ক্ষুদ্রতম একটা অংশ, বিদ্রোহী সেনাবাহিনী এবং ভারত। মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা কত? পরবর্তীতে রক্ষী বাহিনীর উপ-প্রধান আনোয়ার উল আলম শহীদের ভাষ্য হচ্ছে 'দুই লক্ষ—আড়াই লক্ষ'। তখন বাঙালি জনসংখ্যা কত? সত্তরের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের ভোটার ছিল ৫ কোটি ৬০ লাখ। তাইলে জনসংখ্যা আরও বাড়বে। ১৯৬১ ও ১৯৭৪ সালের আদমশুমারিতে যথাক্রমে ৫ কোটি ৮ লাখ ও ৭ কোটি ১৪ লাখ।
 
এর মধ্যে একাত্তরের বয়ানে মূল টার্গেট ছিল হিন্দু। ৬১ আর ৭৪ এর শুমারিতে এদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৯৩ লাখ ৮০ হাজার ও ৯৬ লাখ ৭৩ হাজার। আর ভারতে শরনার্থী প্রায় এক কোটির মধ্যে ৭০ ভাগ ছিল হিন্দু। মানে সর্বসাকুল্যে ৯৩/৯৪ লাখ হিন্দুর মধ্যে ৭০ লাখই ভারতে পালিয়েছিল। এদের মধ্যে প্রায় ১০-১৫ লাখ আর ফিরে আসেনি দেশে। যার কারণে ৫১ আর ৬১'র ধারাবাহিকতায় ৭৪ এর শুমারিতে তাদের পার্সেন্টেজ কমে আসে। তবে ৮১ পরবর্তী শুমারিগুলোতেও দেখা যায়, দশ বছরে এক লাখ বাচ্চাও তারা জন্ম দিতে পারে না।
 
আর গণহত্যার ব্যাপারে যে বয়ান চালু আছে তা নির্জলা মিথ্যাচার। ৩০ লাখ দূরে থাক, ৩ লাখও না। এমনকি 'পঁচিশে মার্চের গণহত্যা' কোন গণহত্যাই না। সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের দমন অভিযান মাত্র। একই সাথে সন্দেহপ্রবণ হয়ে বাঙালি পুলিশ, ইপি‌আর আর সেনাবাহিনীকে নিরস্ত্র করতে গিয়ে বিদ্রোহের শিকার হয় পাক ফৌজ। বাঙালিরা বিদ্রোহের প্রস্তুতি আগে থেকেই নিয়ে রেখছিল অবশ্য। আর নিহতদের মধ্যে বেশিরভাগই প্রো-পাকিস্তানি। যতগুলো গণকবর পাওয়া গেছে তার বেশিরভাগই বিহারী বা পশ্চিম পাকিস্তানি অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে। এদের সাথে কিরকম আচরণ করা হয়েছে তা অকল্পনীয়।
 
তৎকালীন ঢাবি উপাচার্য সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন স্যারের 'একাত্তরের স্মৃতি', কে এম আমিনুল হক সাহেবের 'আমি আলবদর বলছি' পাশাপাশি রেখে এসব ঘটনার ভিক্টিম অথবা প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষাৎকার 'ব্লাড অ্যান্ড টিয়ার্স' (ইংরেজি) পড়লে মাথা হ্যাং হয়ে যাবে। এসবের বাইরে, বাঙালির বৃহত্তর অংশ বিচ্ছেদ চায় নাই। যারা চাইছে, তাদের নিজেদের মধ্যে ছিল বিশাল বিশাল অন্তঃকোন্দল। নিজেরা নিজেরা যুদ্ধ করেছে বহু জায়গায়। এসব যোদ্ধাদের একটা অংশ ছিল সমাজতন্ত্রের আফিম খাওয়া, একটা অংশ ভারত থেকে আসা চুয়ানি খেয়ে মাতাল ছিল। সত্যিকার অর্থে সাধারণ যোদ্ধাদের মধ্যে একটা অংশ ছিল না বুঝে নেমেছে, আরেক অংশ যারা পাক ফৌজের বাড়াবাড়িতে যোগ দিয়েছে। স্বজাতির উল্লেখযোগ্য অংশ প্রটেস্ট করেছে। তবে তারা নির্মম ছিলো না। 
 
একজনকে জানি, তাঁকে দেখি নাই। কিন্তু তাঁর ছেলেদের সাথে, নাতিদের সাথে আলাপ, আড্ডা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের এক সংগঠক একবার ধরা পড়েছিল বাহিনীর হাতে। কিন্তু তিনি তাকে প্রাণে বাঁচিয়েছিলেন। অবশ্য মুজিবের আমলে গ্রেপ্তার হলে সেই সংগঠকও তাঁকে ছাড়িয়ে এনেছিলেন। মূল কথা, স্বজাতির বৃহৎ অংশ যুদ্ধ করে নাই। ছোট্ট একটা অংশ- প্রধানত বিদ্রোহী ফৌজ, লীগ আর বাম কর্মী, দ্বিতীয়ত না বুঝে ফাল পাড়া জনগণ এখনও আছে, তৃতীয়ত পাক ফৌজের বাড়াবাড়িতে ক্ষিপ্ত লোকেরা এতে শামিল হইছে। সব চাইতে বড় ভূমিকা রাখছে ভারতীয় বাহিনী। দৃশ্যত ৭ ডিসেম্বর তারা অভিযান চালাইলেও মূলত এপ্রিল থেকেই গেরিলা অভিযান চালাচ্ছিল র। পার্টির লোকজনের সাথে মিশে যাওয়া তাদের জন্য কঠিন ছিল না। এমনকি এসব বাহিনী পরিচালনাই হইছে য়ের আন্ডারে। সাবেক র অফিশিয়াল আর.কে. যাদবের '1971 Bangladesh war: RAW heroes India forgot to honour' শিরোনামের গর্বিত এসব স্বীকারোক্তিমূলক লেখাটা গুগলে পাওয়া যাবে।
 
এমনকি যুদ্ধ ২৫ মার্চ দূর কি বাত, শুরু হয়েছে ৩০ জানুয়ারি। ওইদিন পরিত্যক্ত একটা জাহাজে ২৬ গিনিপিগ বসায়া হাইজ্যাক নাটক সাজাইছিল র। যে বাহিনীটা গঠনই হয়েছিল পাকিস্তান ভাঙার উদ্দেশে। ওই দিনের পর ভারতের সীমানায় পাক বিমান নিষিদ্ধ হয়। ফলে বিচ্ছিন্ন হয় পাকিস্তান। 
 
এর পরপরই উন্মাতাল হইয়া যায় নিউক্লিয়াস। মুজিবও তাদের সামাল দিতে পারছিলেন না। যার ধারাবাহিকতায় ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে প্রকাশ্য সশস্ত্র মহড়া, সামরিক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম, রাষ্ট্রীয় পতাকা অবমাননা, পোড়ানো, বিহারী নিপীড়ন শুরু করে তারা। বিপরীতে রাজাকার যুদ্ধে গেছে আগস্টে; আল বদর, আল শামস সেপ্টেম্বরে।
 
যুদ্ধ অবশ্যই হইছিল। কিন্তু স্বজাতির বিরুদ্ধে না, ভারতের বিরুদ্ধে। আর স্বজাতির যে ক্ষুদ্র একটা অংশ ছিল তাও শুরু থেকেও ভারতের নিয়ন্ত্রণেই শুধু ছিল না, ভারতের প্রেসক্রিপশনেই সবকিছু করেছে। এ কথা জামায়াত তখনও বলেছে, এখনও বলেছে। একাত্তরের সব কুশীলব এখনও আছে তো। লীগ আছে, হরেক রঙের বাম আছে, জামায়াতও আছে। এদের কারোরই চরিত্র বদলায় নাই। জাস্ট মিলায়ে দেখেন। যে যে ফ্রন্টে ছিল, সে সে ফ্রন্টেই আছে। এদের মধ্যে কে গণবিরোধী? স্বজাতির বিরুদ্ধে কে? এখনও যারা স্বজাতির বিরুদ্ধে, তখনও তারাই স্বজাতির বিরুদ্ধে ছিল।

Share:

এ জমিনের সুরক্ষা সেভাবে করতে হবে যেভাবে মসজিদের সুরক্ষা করা হয়

 
১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগ, পিপলস পার্টি ও ক্ষমতাসীন মার্শাল ল হুকুমতের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে। এতে রাষ্ট্রীয় সংহতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আস্তে আস্তে দেশ উপনীত গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে। এই সময়েই পূর্ব পাকিস্তানে একটি বিশেষ গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে বিদ্রোহের ইশারা বাস্তবে রূপ নিতে লাগে। পহেলা মার্চ থেকেই অবাঙালি ও দেশপ্রেমিক বাঙালিদের গণহত্যা শুরু হয়। আর প্রশাসন অকার্যকর তো হয়-ই, বেশ কয়েক জায়গায় প্রশাসনিক কর্মকর্তারাও বিশৃঙ্খলাকারীদের সঙ্গে মিশে যায়। সমগ্র দেশে ত্রাস সৃষ্টি হয়। সামরিক আইন হারায় কার্যকারিতা। এই বিপদসংকুল পরিস্থিতিতেও রাজনৈতিক সমাধান তালাশ করার বিপরীতে সরকার মূর্খতাপূর্ণ আচরণ জারি রাখে। অন্যদিকে পিপলস পার্টি অব্যাহত উস্কানি আর আওয়ামী লীগ বিদ্রোহের পথে কদম বাড়ায়।

এই দুঃখজনক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র সংঘ ১০ মার্চ ঢাকায় প্রাদেশিক শুরা এবং জেলা সভাপতিগণের সভা আহ্বান করে। সভায় প্রদেশের বিদ্যমান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের পর তিনটি সম্ভাব্য পন্থা উপস্থাপন করা হয়। এর মধ্যে যেকোন একটি বেছে নেওয়ার সুযোগ ছিল। এগুলো হলো—
 
১. পরিস্থিতির স্রোতে মিশে গিয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদের সঙ্গ দেওয়া; অথবা
২. পরিস্থিতিকে নিজের মতো চলতে দেওয়া এবং নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করা; অথবা
৩. পরিস্থিতির গতিপথ বদলে দিয়ে পাকিস্তানের সংহতি রক্ষা ও মজলুম জনগণের সুরক্ষার জন্য ময়দানে অবতীর্ণ হয়ে নিজের দায়িত্ব পালন করা।
 
এই তিন মতের ওপর বেশ বিতর্ক হয়। এসময় প্রাদেশিক শুরা সদস্য (পরবর্তীতে শহীদ) মুস্তফা শওকত ইমরান যুক্তি উপস্থাপন করে তার পক্ষে মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীর (রহ.) বক্তৃতার উল্লেখ করে বলেন“আমাদের নেতা ১৯৪৫ সালে বলেছিলেন, আমরা মনে করি এই জমিন, এই ঘর শুধু আমাদের নয়, বরং ইসলামেরও ঘর। শত বছর পর আল্লাহর দ্বীনকে তার আসল সুরতে প্রতিষ্ঠা করে দুনিয়ার সামনে ইসলামের বাস্তব সাক্ষ্য পেশ করার সুযোগ আমরা সুযোগ পেয়েছি। আমরা এর হেফাজতের জন্য যে কোনো মূল্যে প্রস্তুত রয়েছি। আমরা চাই পাকিস্তানের প্রত্যেক মুসলমানের হৃদয়ে এই নিয়ামতের প্রতি জযবা তৈরি হোক এবং কলব ও রুহ দিয়ে তারা এটি উপলব্ধি করুক যে এই নিয়ামতের হেফাজতের জন্য কোন ত্যাগ-কুরবানিই বড় নয়। মনে রাখবেন, আল্লাহ ও তার দীনের জন্য জীবন উৎসর্গের মূল্য নিজের ঘর-দুয়ার ও ধন-দৌলতের জন্য জীবন দেওয়ার চেয়ে অনেক অনেক বেশি। আর এই জযবার সাথে যে শাহাদাত নসিব হয় তার মাকাম সুউচ্চ। 
 
১৯৬৫ সালের ভারতের হামলার পর মাওলানা বলেছিলেন, পাকিস্তানের প্রতিটি মুসলমান এই দেশ যা উপমহাদেশে ইসলামের দুর্গ এবং যার পুরো জমিন আমাদের জন্য মসজিদের সমান মর্যাদা রাখে তাকে রক্ষা করতে জীবনের বাজি লাগানোর জন্য প্রস্তুতি নিন।” নানান তর্ক-বিতর্কের পর পাকিস্তানের সংহতি রক্ষায় ময়দানে অবতীর্ণ হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ওই সভায়। সভাপ্রধান তা অনুমোদনের সময় তার বক্তব্যে বলেন “এই পরিস্থিতিতে যখন ক্ষমতাসীন সরকারের ভুল নীতি এবং অসহিষ্ণু রাজনৈতিক দলগুলো বিচ্ছিন্নতার পরিবেশ সৃষ্টি করেছে, আমাদেরকে পাকিস্তানের এই ভূখণ্ডের সুরক্ষায় ঠিক সেভাবে ভূমিকা রাখতে হবে যেভাবে মসজিদের সুরক্ষা করা হয়।”
 
অবশ্য সভায় কয়েকজন শুরা সদস্য নিরপেক্ষ অবস্থানের প্রস্তাব তুলে ধরে বলেন, “পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন শক্তি অতীতে কিংবা বর্তমানে কখনোই পূর্ব পাকিস্তানকে আলাদা করে দেওয়ার কোন পদক্ষেপ নেয়নি। কিন্তু দেশ দুই ভাগ হওয়া কিংবা বাঁচানোর দায়িত্ব দেশের রাজনৈতিক, সামরিক এবং প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের। এই পরিস্থিতিতে আমাদের নিরপেক্ষ থাকা দরকার।” তবে অত্যন্ত তর্ক-বিতর্কমূলক এই সভায় কোন সদস্যই বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সঙ্গ দেওয়ার পক্ষে মত দেননি। ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের ব্যাপারে সভার সকল সদস্যই একমত ছিলেন। অবশেষে চার দিনের নানা তর্ক-বিতর্ক ও পর্যবেক্ষণের পর ছাত্র সংঘের এই শুরা সিদ্ধান্ত নেয়—
 
“পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্র সংঘ, পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা এবং নাগরিকদের জান-মাল ও ইজ্জত রক্ষায় অগ্রসর হবে। পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকরা দুই ক্ষতিকর শক্তির লড়াইয়ের মধ্যে অবস্থান করছে। যার একটি অংশ শত্রুভাবাপন্ন; হিন্দুত্ববাদের এজেন্ট ও রক্তাক্ত বিপ্লবের ঝাণ্ডাধারী কমিউনিস্ট— যারা এদেশের স্বাধীনতা ধ্বংস করে একে হিন্দুস্তানের অধীনস্ত বানাতে চায়। অন্যদিকে রয়েছে পাকিস্তানের সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনের অংশীদার একটি চক্রের অপকর্ম। এজন্য একদিকে ইসলামী জযবা নিয়ে ময়দানে দুশমনের মুখোমুখি হতে হবে, অন্যদিকে ক্ষমতার কাছাকাছি থেকে তার সংশোধনে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। একই সময়ে দুই গ্রুপের বিপক্ষে অবস্থান নিতে হলে এর কোন বিকল্প আমাদের সামনে নেই। আমাদের এই সিদ্ধান্ত পাকিস্তানের বেগুনাহ নাগরিকদের জীবন ও ইজ্জত রক্ষার সিদ্ধান্ত।”
 
এই সিদ্ধান্তের ঘোষণা দিতে ১৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জামে মসজিদে কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা ছাত্র সংঘের সভাপতি (পরবর্তীতে শহীদ) সৈয়দ শাহ জামাল চৌধুরী আবেগময় অথচ অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত বক্তৃতার সাথে গৃহীত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। বিপদগ্রস্থ ছাত্র সংঘের কর্মীরা এ ঘোষণার পর একত্রিত হন। ছাত্র সংঘের এই সিদ্ধান্ত পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে দেওয়া বড় কঠিন কাজ ছিল। ডাক ব্যবস্থা ছিল খুবই নাজুক। টেলিফোন চড়া মূল্যই শুধু নয়, অনিরাপদও ছিল। আর লিখিত প্রজ্ঞাপন জারি করা এই পরিস্থিতিতে ছিল মৃত্যু ডেকে আনার শামিল। এজন্য সিদ্ধান্ত হলো চারজন প্রাদেশিক শুরা সদস্য বিভিন্ন জেলা সফর করবেন এবং কর্মীদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিবেন। একইসাথে তারা এই বাণীও পৌঁছাবেন যে—
 
“জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি তুলুন। যতখানি সম্ভব জনগণকে জুলুম ও নির্যাতন থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করুন। পরিস্থিতি শান্ত করতে নিজের সর্বাত্মক প্রভাব ও প্রতিপত্তি ব্যবহার করুন। ...... দীনি ও পাকিস্তানি দায়িত্ব সম্পর্কে পুরোপুরি ওয়াকেবহাল থাকুন এবং যেকোন ধরণের পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য সব সময় প্রস্তুত থাকুন।” ১৫ মার্চ দিবাগত রাতে ওই চার শুরা সদস্য বেরিয়ে পড়েন এবং সপ্তাহ জুড়ে পুরো পূর্ব পাকিস্তানের বিভাগ ও জেলা কেন্দ্রগুলোতে সফর পূর্ণ করেন। সেখানে কর্মীদের জমায়েত করে এ সিদ্ধান্ত সম্পর্কে অবগত করা হয়। আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করে ইসলাম আর পাকিস্তানের সুরক্ষার জন্য দোয়া করে বিদায় নেওয়ার সময় তৈরি হতো আবেগঘন মুহূর্ত। একে অপরের থেকে এমনভাবে বিদায় নিতেন যেন দুনিয়ায় দু’জনের আর কখনও মোলাকাত হবে না, আর তারা যাত্রা করতে চলেছেন এক অনিঃশেষ মঞ্জিলের দিকে।
আল বদর, সালিম মনসুর খালিদ
 


Share:

আল বদরের শহীদদের সংক্ষিপ্ত একটি তালিকা

 

১. শহীদ ইবরাহীম:

ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্য প্রার্থী এবং নোয়াখালী সরকারী কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি ছিলেন। স্কুলে পড়াশোনাকালে একদিন রাস্তায় স্থানীয় দায়িত্বশীল আবু নাসিরের সঙ্গে দেখা হয়। তিনি জানতে চান 'আপনারা সব সময় কী কাজ করেন? আমাকেও বলেন। আমিও করতে চাই।' রাস্তার এই পরিচয় তাকে সিরাতুল মুসতাকিমের রাহী বানায় এবং সেই পথে চলতে চলতে ডিসেম্বরে শাহাদাতের মঞ্জিলে পৌঁছে যান।

২. শহীদ আবু তাহের আনসারী:

বাঁশখালী (চট্টগ্রাম) থানার একটি মাদ্রাসায় ফাযিলের ছাত্র ছিলেন। দেশের অবস্থা খারাপ হয়ে গেলে মাদ্রাসা ছেড়ে চলে আসেন সংঘের দফতরে। নবযৌবন তার। আল বদরে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন। নাযিম (সভাপতি) তার জিদের কাছে হার মানেন। তাকে বলেন, 'আচ্ছা, তাইলে আপনি দফতরে ডিউটি দেন।'আবু তাহের জবাবে বলেন, আমি গাজী হতে চাই। শহীদ হতে চাই। শাহ জালালের সঙ্গী হয়ে যামানার এই মুয়াজ লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন। স্থানীয় কমান্ডার শাহ জালালের নির্দেশে পরিচালিত একটি অভিযানে ভারতীয় বিমান হামলায় তিনি শহীদ হয়ে যান।

৩. শহীদ আনওয়ার হোসাইন:
আনওয়ার হোসাইন মাত্র ১৪ বছর বয়সে শাহাদাত হাসিল করেছেন। তিনি তখন নরসিংদী মডেল স্কুলের ছাত্র। বাবা তাফাসসুল হোসাইনের নির্দেশে ছাত্র সংঘে শামিল হন। কয়েক মাসের মধ্যেই একাত্তরের রক্তাক্ত পরিস্থিতি শুরু হয়। তিনি প্রথমে রাজাকার ফোর্সে অংশ নেন। পরে আল বদর গঠন হলে সেখানকার সক্রিয় মুজাহিদ হয়ে ওঠেন।

ডিসেম্বরে পাকিস্তানি ফৌজ পশ্চাৎপদ হলে বাবা-মাকে নিয়ে নৌকাযোগে তিনি বৈদ্যমারা যাচ্ছিলেন। এমন সময় মুক্তিবাহিনীর গুণ্ডাদের হাতে পড়ে যান। হাত-পা বেঁধে স্থানীয় একটি স্কুলে নিয়ে সারারাত মায়ের সামনেই নির্মম নির্যাতন চালানো হয় তার ওপর। এরপর ছুরির আঘাতে আঘাতে ক্ষতবিক্ষত দেহটি মেঘনার স্রোতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। নির্মম নিপীড়নে মায়ের হাড্ডিও ভেঙে দেয় মুক্তিবাহিনীর গুণ্ডারা। আজও সেই ভাঙা হাঁড় থেকে মমতার কণ্ঠ শোনা যায়। ঘরের প্রদীপই নিভিয়ে দেয়নি শুধু, গুণ্ডারা তাদের বাড়িটিও লুটপাট করে বিরান করে ফেলে।

৪. শহীদ মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম:
রাজশাহী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের শিক্ষার্থী মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম ছাত্র সংঘের সাথী এবং শহরের রানীনগর আবাসিক শাখার ইনচার্জ ছিলেন। আল্লাহ তায়ালা তাকে চমৎকার সাংগঠনিক দক্ষতা দান করেছিলেন। বাগ্মী ছিলেন, ছিলেন সাহিত্যিকও। হিন্দুস্তানী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জান উৎসর্গ করে খিদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছিলেন। মুক্তিবাহীনীর চোখে তিনি হয়ে উঠেছিলেন আতঙ্কের নাম। ঢাকার পতন হলে ১৭ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী তাকে ধরে ফেলে। নির্যাতন করতে করতে তাকে শহীদ করে পদ্মায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়।

৫. শহীদ নুরুজ্জামান:
দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র এবং সংঘের সাথী। শাহাদাতের দুই দিন আগে এক সঙ্গীর মাধ্যমে বাবাকে চিঠি পাঠিয়েছিলেন। লিখেছিলেন, আমি আল্লাহর রাহে জিহাদ করছি। দুয়া করবেন, যেন শাহাদাতের মৃত্যু নসিব হয়। এটি সেই মৃত্যু, খালিদ বিন ওয়ালিদের (র.) মত জেনারেলরা যার কামনা করেছিলেন। নুরুজ্জামানের এই তামান্না পূরণ হয়। শাহ জালালের সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরে দায়িত্ব আঞ্জাম দিতে গিয়ে ভারতীয় বিমান হামলায় শহীদ হয়ে যান তিনি। 

৬. শহীদ মুহাম্মদ ইসমাইল:
নোয়াখালীর টুমচর বেশ কয়েকজন শহীদকে জন্ম দিয়েছে। তার একজন মুহাম্মদ ইসমাইল। তার বাবা মাওলানা হাফিজুল্লাহ টুমচরে মাদ্রাসা শিক্ষক ছিলেন। অতিরিক্ত লম্বা আর স্বাস্থ্যে দুর্বল ছিলেন ইসমাইল। ম্যাট্রিকের সময় তিনি সংঘের কর্মী হন। প্রথম বর্ষে ভর্তি হন আল বদরে। বিভিন্ন স্থানে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ডিসেম্বরে শত্রু যখন বিজয়ী হয়, তখন তাকে গ্রেফতার করে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হয়। তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তখন তার বয়স হয়েছিল ১৮ বছর। 

৭. শহীদ আমিনুল ইসলাম:
জামালপুরের সবচেয়ে ক্রিয়াশীল এবং অস্ত্রচালনায় তুখোড় মেধাবী আমিনুল ইসলামের বাড়ি ছিল মধুপুরে। ছাত্র সংঘের সাথী ছিলেন। হয়েছিলেন আল বদরের কোম্পানি কমান্ডার। ১৪ ডিসেম্বর ঢাকার দিকে মার্চ করেন। মিরপুর পৌঁছানোর পর মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। ওই লড়াইয়ে তিনি শাহাদাতের পেয়ালা পান করেন। 

৮. শহীদ ইসমাইল হোসাইন:
কুষ্টিয়ার আলিয়া মাদ্রাসা থেকে পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে শেষ বর্ষের ছাত্র ছিলেন। ১৯৬৫ তে সংঘের কর্মী এবং ৭১ সালে সদস্য হন। ঢাকার আইয়ুব কলোনীর তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। ইসলামী আন্দোলনের সুপরিচিত এই যুবক ছিলেন কবি। পুনরুত্থান ও রাহবার সহ তিনটি রচনা প্রকাশ পেয়েছিল। বিষয়ের দিক থেকে তার গদ্য ছিল ইতিহাস ও রাজনীতি বিষয়ক। আল বদরের এক জাগ্রত বিবেক মুজাহিদ ছিলেন তিনি। বাঙালি ও বিহারীদের মধ্যে এক মিশনে গিয়েছিলেন। বিহারীরা তাকে শহীদ করে।

৯. শহীদ আব্দুস সাত্তার:
কুষ্টিয়ার কুমারখালীর শহীদ আব্দুস সাত্তার। বাবা আযহার আলী সাহেব ১৯৭০ সালে ইন্তেকাল করেন। কুমারখালী এম‌এন হাই স্কুলে দশম শ্রেণির ছাত্র থাকা কালেই একজন দায়িত্বশীল কর্মী হিসাবে ছাত্র সংঘে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন সাত্তার। আল বদরে অংশ নিয়ে প্রশিক্ষণ নেন। কুষ্টিয়ার পতনের পর তার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। অনুমান করা হয় মুক্তিবাহিনীর হাতে তিনি শহীদ হয়েছেন। তিনি তখন ১৭/১৮ সালের কিশোর ছিলেন। 

১০. শহীদ মুহাম্মদ ইলিয়াস:

নোয়াখালীর আহমদপুরে জন্মগ্রহণ করেন। ছাত্রজীবনে ইসলামী ছাত্র সংঘ করতেন। মিছিলে সবার আগে স্লোগান দেওয়া, দাওয়াতি এবং প্রচারণামূলক পোস্টার নিজে প্রস্তুত করে বিভিন্ন জায়গায় লাগানোর জন্য তাকে জানত না এমন কেউ নেই। পড়াশোনা শেষ তখন দু বছর হয়েছে। এক বছর আগে বিয়েও করেছেন। এমন সময় মাতৃভূমির আহ্বানে তিনি ঘর-সংসার ত্যাগ করে আল বদর ক্যাম্পে চলে আসেন। প্রশিক্ষণ নিয়ে দায়িত্ব আঞ্জাম দেওয়া শুরু করেন। ৭ ডিসেম্বর তিনি শত্রুদের হাতে বন্দি হন। তার ঈমানের পরীক্ষা শুরু হয়ে গেল। আহমদপুর পর্যন্ত তার উপর লাঠি বর্ষণ হতে থাকে। লাঠির আঘাতেই তাকে শহীদ করা হয়। আহমদপুরে নিজ বাড়ির সামনে তার কবর রয়েছে। শাহাদাতের সময় তার বয়স হয়েছিল ২৫।

১১. শহীদ মুহাম্মদ কামাল:

মেডিকেল কলেজের এই ড্রাইভার আপাদমস্তক ছিলেন একটি আন্দোলন। ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্ক, ইবাদতে মশগুলিয়াত আর সংঘের কর্মীদের স্নেহ তার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। মিছিল আর সমাবেশ আয়োজন ও এন্তেজামে স্ব-ইচ্ছায় এগিয়ে আসতেন, সব সময় ছিলেন অগ্রগামী। ১৬ ডিসেম্বর তার গ্রাম থেকে মুক্তি বাহিনী তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। তাকে শহীদ করে পদ্মায় ফেলে দেওয়া হয়। তখন তার বয়স হয়েছিল ২৭ বছর

১২. শহীদ আবুল কালাম:
শহীদ আবুল কালাম নোয়াখালীর শোলাখালীতে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা তাজুল ইসলাম ছিলেন কৃষক। ফেনী কলেজে ভর্তি হওয়ার পর আবুল কালাম ইসলামী ছাত্র সংঘে শামিল হন। লেখালেখি এবং বক্তৃতার দক্ষতা আল্লাহ তাকে অনেক দিয়েছিলেন। ইতিহাসের প্রতি তার গভীর অনুরাগ ছিল। ১৯৭১ সালে আল বদরে শামিল হন। ৮ ডিসেম্বর তাকে কাজী বাজার থেকে ধরে ফেলে শত্রুরা। কাছেই একটি কামারের কাছে নিয়ে গিয়ে তার শরীরে ছ্যাঁকা দেয় তারা। তার শরীর ক্ষত-বিক্ষত হতে থাকে। বইতে থাকে রক্তের স্রোত। কাছেই মুক্তিগঞ্জে একটি গাছে উল্টা ঝুলিয়ে রাখা হয়। এ অবস্থায় ৯ ডিসেম্বর তিনি এই নশ্বর দুনিয়া ত্যাগ করেন।

১৩. শহীদ মুহাম্মদ সোহরাব আলী:
মুহাম্মদ সোহরাব আলীও কুমারখালীর ছিলেন। বাবা ইমান আলী সুতার ব্যবসা করতেন। নবম শ্রেণিতে থাকতে তিনি ছাত্র সংঘে সম্পৃক্ত হন। ১৯৭১ সালে জেএন হাই স্কুলে দশম শ্রেণির ছাত্র এবং সংঘের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। এ সময়ই আল বদরে শামিল হন। পাক ফৌজের পরাজয়ের পর পলাতক অবস্থায় মুক্তিবাহিনীর হাতে আটক হন। তাকে ২২ ডিসেম্বর অকথ্য নির্যাতনের মাধ্যমে শহীদ করা হয়। 
 

১৪.  শহীদ লুতফুর রহমান:
জামালপুর কলেজে বিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। তিনি সংগঠনের সাথী ছিলেন। ছিলেন খুবই ক্রিয়াশীল। জামালপুরে ভারতীয় বাহিনীর হামলা হলে তিনি সঙ্গীদের কাছে যেতে অন্যত্র রওনা দেন। রাস্তা থেকে কলেজের দুই গুণ্ডা তাকে আটক করে মুক্তিবাহিনীর কসাইখানায় নিয়ে যায়। চরম নিপীড়নের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় দিনই তাকে শহীদ করা হয়।
"আমাদের শহীদেরা সবচেয়ে বড় সম্পদ
রেখে গেছে সাহসের দ্বিধাহীন সোজা রাজপথ"

সালিম মানিসুর খালিদের আল বদর বই থেকে অনূদিত।

Share:

বেদনার উপাখ্যান: কাদিয়ানি সেনা কর্মকর্তার প্রতিহিংসার শিকার শহীদ শাহ জামাল ও আব্দুস সালাম


কী আশ্চর্য ঘটনা! শহীদ আব্দুল মালেকের পর ছাত্র সংঘের দ্বিতীয় শহীদও ঢাকা ছাত্র সংঘের সভাপতি ছিলেন।সৈয়দ শাহ জামাল চৌধুরী ঢাকা ছাত্র সংঘের সভাপতিত্বের পূর্বে পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্র সংঘের সেক্রেটারি জেনারেল ছিলেন। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র। ইসলামী আন্দোলনে শামিল হওয়ার অপরাধে বাবা-মা তাকে ভালো নযরে দেখত না। কিন্তু তার মনোবল ও প্রত্যয় এত বেশি ছিল যে তিনি রাত আড়াইটা-তিনটা পর্যন্ত কাজ করে মেঝেতে বিছানা সাজিয়ে সামান্য ঘুমিয়ে নিতেন। শাহ জামাল জন্মেছিলেন সিলেটে। ১৯৬৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সদস্য প্রার্থী হন, আর সদস্য পদ মঞ্জুর হয় ওই বছরেরই ১৮ আগস্ট।

 ৯ এপ্রিল ১৯৭১ পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্র সংঘের প্রাদেশিক পরিষদের সভা ছিল। এই সভায় উপস্থিতির জন্য ফরিদপুর জেলা সভাপতি আব্দুস সালামকে বিশেষ দাওয়াত দেওয়া হয়েছিল। সভা শেষে রাত প্রায় ৯টার দিকে শাহ জামাল চৌধুরী ও আব্দুস সালাম ছাত্র সংঘের দপ্তর (১৫, পুরানা পল্টন) থেকে বের হন। এরপরই নিখোঁজ হন তারা। পরে জানা গেল, দপ্তর থেকে বের হতেই ওঁৎ পেতে থাকা পাক ফৌজের জনৈক কাদিয়ানী কমান্ডার তাদের তুলে নেয়। কিছু দূর গিয়ে আরেকজনকে আটক করা হয়। তিনজনের চোখে কাপড় বেঁধে জিপে নিয়ে অন্যত্র রওনা দেয়। তৃতীয়জন পরে জানায়— আমার আগে যে দু’জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল তারা সামরিক সরকারের দেওয়া পরিচয়পত্র ওই অফিসারকে দেখিয়েছেন। বলেছেন আমরা শান্তি কমিটির সদস্য। তারা এও বলেছেন যে— ‘যে কোন দেশপ্রেমিক নেতা অথবা উচ্চ পদমর্যাদার অফিসারদের থেকে এই সত্যতা নিশ্চিত করা হোক।’ কিন্তু সে মানেনি। সম্ভবত তাদেরকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।
 
এই সাক্ষ্য পাওয়ার পর ছাত্র সংঘের দায়িত্বশীল নেতৃবৃন্দ জেনারেল টিক্কা খান কর্তৃক তাদের মুক্তির আদেশ জারি করানোর জন্য বহু চেষ্টা করেন। কিন্তু এতে কোন সফলতা আসেনি। সৈয়দ শাহ জামাল ও আব্দুস সালামও হকের রাহে নিজেদের জান কুরবান করে দিয়েছেন, সংশ্লিষ্ট সেনা কর্মকর্তাদের বাতচিত ও আচরণ থেকে এই সন্দেহই বিশ্বাসে পরিণত হল! শাহ জামাল চৌধুরী ছাত্র সংঘের জন্য সম্ভাবনাময় ছিলেন। এভাবে তার হারিয়ে যাওয়ায় ছাত্র সংঘ বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ছাত্র সংঘের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি মতিউর রহমান নিজামী শাহ জামাল সম্পর্কে লিখেছেন, “পড়ালেখায় শাহ জামাল ছিলেন মধ্যম মানের। কিন্তু তার বড় গুণ ছিল এই যে, কোন সিদ্ধান্ত হয়ে গেলে তা বাস্তবায়নে যে প্রত্যয় ও সিরিয়াসনেস প্রয়োজন, তা তার মধ্যে ছিল। সাংগঠনিক বোঝাপড়া শহীদ আব্দুল মালেকের চেয়েও ভালো ছিল তার। খোশমেজাজি ছিলেন। এই গুণ আব্দুল মালেকের মধ্যেও ছিল। কিন্তু আব্দুল মালেকের চেহারায় একটা নিষ্পাপ হাসি ছিল। আর শাহ জামালের হাসিতে লেপ্টে লেগে থাকত খোশমেজাজ।
 
যাদের মধ্যে সাংগঠনিক দক্ষতা বেশি, তাদের মধ্যে আনুগত্যের অনুভূতি কম থাকে। কিন্তু তার মধ্যে এই দুর্বলতা ছিল না। শাহ জামাল ভাই এক বছর আমার প্রাদেশিক সেক্রেটারি ছিলেন (শহীদ নিজামী সাহেব তখন প্রাদেশিক শাখার সভাপতি)। পরের বছরই ঢাকা শহর শাখায় স্থানান্তরিত হন। কাজ করেন শহীদ আব্দুল মালেকের অধীনে। তার মধ্যে আনুগত্যের যে স্পিরিট ছিল তা অভাবনীয়। এক দফা প্রাদেশিক শাখায় কাজ করার পর শহর শাখায় শিফট হওয়া! বড় একটা পরীক্ষা। আর তিনি এতে পরিপূর্ণ রূপে উত্তীর্ণ হন। তাকে যখন সেক্রেটারি বানানো হয়, তখন তিনি ডিগ্রি পরীক্ষার্থী ছিলেন। অধিক সাংগঠনিক কাজের কারণে তার পরীক্ষার ফল খারাপ হয়। এজন্য আমরা তাকে এক মাস ছুটি দেই। আর গ্রাজুয়েশনের পর শহর শাখায় শিফট হন। মুয়ামালাতের ক্ষেত্রে তার কোন ধরণের জটিলতা বা সমস্যা তৈরি হতো না। তিনি ছাত্র সংঘের মেজাজ, সঙ্গী-সাথীদের জন্য জান কুরবান আর আন্দোলনের পরিবেশ তৈরিতে অবদান রেখে গেছেন। 
 
যে রাতে তিনি শহীদ হন, তার আগের একটি ঘটনা আমাকে খুব হয়রান করে। জানি না তার মধ্যে এই উপলব্ধি কিভাবে জন্ম নিয়েছিল! সেদিন ঢাকা ছাত্র সংঘের সমস্ত হিসাব-কিতাব ঠিকঠাক করে যান তিনি। সাধারণত মাস শেষ হওয়ার পরই হিসাব পূর্ণ করা হয়ে থাকে। হিসাব করতে গিয়ে দুয়েক জায়গায় ঠিকঠাক স্মরণ করতে পারছিলেন না। এজন্য খুব পেরেশান ছিলেন তিনি। আমার সামনে সেই পেরেশানি ধরা পড়ে। তিনি বলছিলেন, ‘অমুক অমুককে এই এই কাজের জন্য কিছু পয়সা দিয়েছিলাম। তারা যে হিসাব দিয়েছে তা তো অপূর্ণ। এতে এখন আমার দায়িত্ব কী হবে!’ অন্যরা অপূর্ণ হিসাব দিলেও নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে তিনি অস্থির ছিলেন। তখন তাকে আমি ভরসা দেই। আমি জানতাম না যে এখানে অন্য কিছু ঘটতে যাচ্ছে। এর কয়েক ঘন্টা পরেই এক কাদিয়ানী সেনা কর্মকর্তা তাকে গুম করে নেয়। ফরিদপুর জেলা সভাপতি আব্দুস সালাম ভাইও তার সাথে ছিলেন। দুইজনকেই শহীদ করা হয়।”
 
একটা গ্রুপ শহীদ সৈয়দ শাহ জামাল সম্পর্কে অপবাদ দেয় যে, তিনি কথিত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলেন এবং পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষায় যুদ্ধে অংশগ্রহণের বিরোধিতা করেন। ফলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাকে হত্যা করে।
কিন্তু যুদ্ধে অংশ নেওয়া না নেওয়া কিংবা পক্ষ- বিপক্ষ নির্ধারণ এপ্রিলে হয়নি, হয়েছে মার্চে। ১০ মার্চ থেকে ১৩ মার্চ প্রাদেশিক পরিষদের সভায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ওই সভায় পক্ষে-বিপক্ষে নানান আলোচনা হয়। এ ব্যাপারে অত বিস্তারিত জানা যায় না। শাহ জামাল চৌধুরীই শুধু নয়, আরও অনেকেই সেখানে দ্বিমত করে থাকতে পারেন। কিন্তু সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয়ে যাওয়ার পর তার মধ্যে কোন পিছুটান লক্ষ্য করা যায়নি। ১৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে ওই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন খোদ সৈয়দ শাহ জামাল চৌধুরী। তার আবেগময় বক্তব্য সেদিন ঢাকার কর্মীদের উজ্জীবিত করে বদরের চেতনায় পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে সঙ্গীন হাতে ঝাঁপিয়ে পড়তে। এখানে সেনাবাহিনীর এই আচরণ ও ছাত্র সংঘ-আল বদরের পরিস্থিতি বুঝতে আরেকটু যুক্ত করা চলে— “১৯৭১ ইসলামী ছাত্র সংঘের জন্য অত্যন্ত নাজুক একটা বছর ছিল। আল বদরের একজন কমান্ডার আমাকে জানান—
 
আমরা খুবই বাজে পরিস্থিতিতে পড়েছিলাম। আমাদের সাথীরা এক দিকে ভারতীয় হানাদার বাহিনী, বাঙালি জাতিবাদী, কমিউনিস্ট আর হিন্দু অন্যদিকে কখনও কখনও খোদ পাক বাহিনী এবং উর্দুভাষী; এই ছয়টি পক্ষের নির্যাতনের মুখোমুখি হয়েছে। যেমনটা আগেও বলা হয়েছে, উর্দুভাষীদের মধ্যে বাঙালিদের বিরুদ্ধে যে প্রতি-ঘৃণা জন্ম নিয়েছিল, তার ফলস্বরূপ বিভিন্ন জায়গায় তারা বাঙালিদের উপর জুলুম চালায়। আর আল বদরের সকল মুজাহিদ ছিল বাঙালি। কাজেই তারাও বিভিন্ন সময় উর্দুভাষীদের প্রতিশোধের শিকার হয়। এই চতুর্মুখী সংকটের মধ্যেও আল বদর অটল ও অনড় অবস্থান ধরে রাখে। কারণ আল বদর ইসলামের নামে অর্জিত পাকিস্তান ও এই দেশের সাধারণ জনগণকে বাঁচানোর জন্য হাতিয়ার তুলে নিয়েছিল। কারো পুরস্কারের আশায় নয়। আর তারা কেবল আখিরাতেই এর পুরস্কারের প্রতাশা রাখে।”
সালিম মানসুর খালিদ, আল বদর।
Share:

ঢাকা পতন: সালিম মানসুর খালিদের 'আল বদর' বই থেকে

 ১.
হুকুম এলো, পিছিয়ে যাও
আল বদর প্রতিষ্ঠাতাদের একজন ছিলেন কামরান। শেরপুর ও জামালপুরে বিভিন্ন যুদ্ধে তিনি অংশ নিয়েছেন, দিয়েছেন নেতৃত্ব। কিন্তু কামালপুরের গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটিটি হারানোর পর পাক ফৌজের মনোবল ভেঙে গেলে তারা ভারতীয় বাহিনীর সামনে আত্মসমর্পণ করে ফেলে। কামরানের জবানিতে সালিম মানসুর খালিদ তাঁর 'আল বদর' বইতে এর বর্ণনা দিয়েছেন এরকম-
 
২৮ নভেম্বরের পর কামালপুরের সাথে আমাদের আর সংযোগ ছিল না। ৩ ডিসেম্বর ক্যাপ্টেন আহসান সিদ্দিকীর নেতৃত্বে কামালপুর বিওপির সৈন্যরা অস্ত্র সমর্পণ করে। তবে বখশিগঞ্জে আরও দুই দিন যুদ্ধ হয়। ওখানে মেজর আইয়ুব খান কমান্ড করছিলেন। শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত লড়তে লড়তে তিনি শহীদ হন। ৫ ডিসেম্বর হিন্দুস্তানি সৈন্যরা পুরো এলাকা নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়। তখন আমরা সামরিক ঘাঁটি ছেড়ে গাছ-গাছালি আর ক্ষেতের আড়ালে লুকিয়ে গেরিলা আক্রমণ করতে লাগলাম। স্পষ্টতই, ওই পরিস্থিতিতে এটা কোন কার্যকর উপায় ছিল না। ফলে কর্নেল সুলতান আহমদ আমাদের আরও পিছনে সরার নির্দেশ দিলেন। ৭ ডিসেম্বর আমরা জামালপুরে পৌঁছালাম। ৮ ডিসেম্বর শহরের চারদিকে আমরা পজিশন নেই। এখানে পাক ফৌজের পাঁচ ব্যাটালিয়ন আর আল বদরের তিনটি কোম্পানি ছিল।
 
৮ ডিসেম্বর পাক আর্মি অফিসারদের মিটিং হলো। আল বদরের পক্ষে আমি অংশ নিলাম। সভায় সিদ্ধান্ত হলো, গেরিলা যুদ্ধ করতে করতে পুনরায় সেখানে ফিরে যেতে হবে, যেখান থেকে পিছু হটেছিলাম। এ সময়ে ভারতের বিমান হামলা তীব্রতর রূপ নেয়, যাতে আমাদের খুব লোকসান হচ্ছিল। এরকম একটি হামলায় আল বদর ক্যাডেট আব্দুস সামাদ ও তার দুই সাথী শহীদ হয়। তবুও আমরা দশ ডিসেম্বর রাত পর্যন্ত জামালপুর রক্ষা করি। কিন্তু ১০ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে হুকুম এলো, 'পিছে হাট যাও' (পিছু হটো)। তীব্র শীতের কারণে আমি অসুস্থ ছিলাম। সামান্য নড়াচড়াও আমার জন্য মুশকিল ছিল। এজন্য আমি জামালপুরেই থেকে গেলাম। পাক ফৌজ শহর ছাড়লো, এলো ভারতীয় বাহিনী। আল বদরের স্বেচ্ছাসেবীরা গেরিলা যুদ্ধের জন্য শহর ছেড়ে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে গেল। আর আমি শহরে রইলাম, একা। পরদিন সকাল দশটায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অস্ত্র সমর্পণ করে। পরে আল বদরের তিন মুজাহিদ আমার কাছে এসে সাক্ষাৎ করে। তারা মোট পাঁচজন ভারতীয় বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছিল। তিনজন কোনমতে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে।
 
ছবি: কামালপুর বিওপির সৈন্যদের আত্মসমর্পণের ছবি। এই গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত ঘাঁটিটি দখলের জন্য জুন থেকে মোট ২০ বার গেরিলা হামলা চালানো হয়েছে। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট চারবার নেমেছে সম্মুখ সমরে। যুদ্ধে উভয় পক্ষের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে ৩১ জুলাই প্রথম যুদ্ধে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বড় ধরণের মাইর খায় এখানে। কামালপুর এতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে এখানে যুদ্ধ করা ২৯ জনকে বীর প্রতীক ও বীর উত্তম খেতাব দেওয়া হয়েছে। একক যুদ্ধক্ষেত্র হিসাবে এটিই সর্বোচ্চ খেতাব নিয়ে গেছে।
 
"শত্রুকে না দিয়ে অস্ত্র আমাদের দিন, আমরা লড়ব"
১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় আত্মসমর্পণের আগের ঘটনাগুলোর বর্ণনা দিয়েছেন আশরাফুজ্জামান-
ঢাকা পতনের কিছু দিন আগেও আল বদরের মুজাহিদরা ময়মনসিংহ, চাঁদপুর আর কুমিল্লা প্রভৃতি এলাকায় ভারতীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধ করছিল। পাক ফৌজ তাদের কোন কিছু না জানিয়েই ঢাকায় সরে আসতে থাকে। আমাদের মুজাহিদরা এটা বুঝতে পেরেও কম রসদ নিয়েই শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত লড়াই করে। আর কিছু সদস্য ঢাকায় চলে আসে। ঢাকার বিরূপ পরিবেশে পাক ফৌজ ভারতীয় ফৌজের সাথে লড়াই করছিল। আমরা প্রায় আট-নয়শ আল বদর মুজাহিদ ক্যাম্পে অবস্থান করছিলাম। পাক হেড কোয়ার্টারের কাছেই আমাদের ক্যাম্প বসানো হয়েছিল। ক্যাম্পে রাত-দিন অনেক ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। এমনকি খবর শোনারও ফুরসত ছিল না।১৬ ডিসেম্বর সকালের ঘটনা। ৯টার সময় হতে পারে। যথারীতি দুই-তিন জায়গায় অপারেশনের পরিকল্পনা নিয়ে ক্যাম্প থেকে রওনা হতেই যাচ্ছিলাম। তখন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র সংঘের সভাপতি, ঢাকা সভাপতিসহ মোস্তফা শওকত ইমরান গাড়ি নিয়ে আসলেন। তিনি তথ্য বিভাগের ইনচার্জ ছিলেন। সাথে আরও দুয়েকজন ছিল। তিনি বললেন, "রাতে আমরা ভয়েস অব আমেরিকা আর বিবিসিতে শুনেছি যে পাক ফৌজ অস্ত্র সমর্পণ করে ফেলেছে। চলো, আর্মি হেড কোয়ার্টার থেকে আসল সুরতহাল জেনে আসি।" আমি জবাব দিলাম, আমার কাছে সময় নাই। দুয়েকটা জরুরি কাজ করতে হবে। মনে হচ্ছে অস্ত্র সমর্পণের খবর প্রোপাগান্ডা হবে।
 
আমার ধারণা এমনটাই ছিল। কিন্তু তারা আমাকে জবরদস্তি আর্মি হেড কোয়ার্টারে নিয়ে গেলেন। প্রথমে কর্নেল হিজাযীর সাথে সাক্ষাৎ হলো। উনি বললেন, ভালো হয় আপনারা ব্রিগেডিয়ার বশির সাহেবের সাথে কথা বলেন।
ব্রিগেডিয়ার বশির সাহেবের সাথে সাক্ষাৎ হলো। তিনি পাক ফৌজ ও আমাদের মধ্যকার লিয়াজো রক্ষার দায়িত্বে ছিলেন। উনি বললেন, রাত আটটার মধ্যে সব কিছু জানা যাবে। মোস্তফা শওকত ইমরান জিজ্ঞাসা করলেন, আপনারা যদি আত্মসমর্পণ করেন তাহলে আমাদের ব্যাপারে কী ভেবেছেন? তিনি জবাব দিলেন, আপনারা সিভিল ড্রেস পরে সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশে যাবেন। অথবা উর্দি পরে আমাদের সাথে অস্ত্র সমর্পণ করতে পারেন। তারপর যা আমাদের সাথে হবে, আপনাদের সাথেও তাই হবে। কিন্তু আমার ইচ্ছা, আমাদের দুর্ভোগ আপনাদের পোহানোর দরকার নাই। আমি তো এখনও এটা বুঝতে পারছি না। 
 
যে পাক ফৌজ হিন্দুস্তানিদের সামনে অস্ত্র সমর্পণ করছে! ইমরান বললেন, আল বদরের একটা সদস্যও এই বেইজ্জতির জন্য প্রস্তুত না। অন্তত আপনারা যে অস্ত্র দুশমনের সামনে জমা দিচ্ছেন, সেগুলো আমাদের দিয়ে দেন। আমরা লড়বো। ব্রিগেডিয়ার সাহেব কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বললেন, আমাদের ক্ষমতাই বা কী! না কোন অর্ডার দিতে পারি, আর না হাতিয়ার। উপর থেকে যে হুকুম হয় তারই তামিল করতে হয় আমাদের। হেডকোয়ার্টার থেকে আমরা চলে আসি। ব্রিগেডিয়ার সাহেবের কথায় আমাদের আন্দাজ হয়ে গেছিল যে বড় কিছু ঘটতে যাচ্ছে। ক্যাম্পে পৌঁছে অন্য সাথীদের পরিস্থিতি অবগত করলাম। যতটুকু সম্ভব টেলিফোনের মাধ্যমে ক্যাম্পগুলোতে সতর্ক করে পরামর্শ দিলাম সিভিল ড্রেস পরে আড়াল হয়ে যেতে । এরপর (সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি) খুররম জাহ মুরাদের গাড়িতে ওখান থেকে বেরিয়ে গেলাম। সাথে আরও কয়েকজন। তাদের মধ্যে আসাদুজ্জামান শেষ পর্যন্ত আমার সাথে ছিল। সে ছিল প্লাটুন কমান্ডার, ছাত্র সংঘের সদস্য প্রার্থী। আমরা ধানমণ্ডিতে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের অফিসে পৌঁছলাম। তখন আমাদের কাছে সর্বসাকুল্যে দু’শ টাকা ছিল। ওটা দপ্তরের এক চাপরাশিকে দিয়ে শহর পর্যবেক্ষণ করতে বিভিন্ন দিকে বেরিয়ে গেলাম। রাত নয়টার দিকে টেলিফোনের সব সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। হতে পারে পাক ফৌজ অথবা মুক্তি বাহিনী তারগুলো কেটে দিয়েছে।
 
(ক্যাম্প থেকে বের হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় শুরা সদস্য মোস্তফা শওকত ইমরান মুক্তিবাহিনী ও আওয়ামীলীগের হাতে আটক হন। অবর্ণনীয় নির্যাতনের পর ১৮ ডিসেম্বর প্রকাশ্যে তাঁর বুক চিরে কলিজা বের করে তাঁকে হত্যা করা হয়।)
 
ফোঁপানি আর অশ্রুর বান
চট্টগ্রামে ১৬ ডিসেম্বরের মূহুর্তগুলোর বর্ণনা দিয়ে মোহাম্মদ মনসুর বলছিলেন-
আমরা চট্টগ্রামের দশ মাইল দূরে একটি সেক্টরের দায়িত্বে ছিলাম। ১৫ ডিসেম্বর রাতে ভয়েস অব আমেরিকায় শুনলাম যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অস্ত্র সমর্পণ করে ফেলেছে। আমাদের সুবেদার গালি দিয়ে উঠলেন। তিনি বললেন, আমরা সারেন্ডার করতে পারি না। এসব বানানো খবর। সকালে ওয়ারলেসের মাধ্যমে হেড কোয়ার্টারে যোগাযোগ করলাম। বলা হলো, এরকম কোন তথ্য নাই। যুদ্ধ চালিয়ে যাও। ওই দিনও আমরা যুদ্ধ করছি। কিন্তু সাড়ে বারোটার দিকে ভারতীয় বাহিনী ফায়ারিং বন্ধ করে দিয়েছিল। আমরাও চুপ হয়ে গেছিলাম। পরে ছাত্র সংঘের এক সদস্য আবু সরওয়ার শহর থেকে আমাদের কাছে এলেন। তিনি আল বদরের সকল মুজাহিদকে একত্রিত করলেন। আমরা প্রায় পঞ্চাশ জন মত ছিলাম। জিজ্ঞাসা করলেন, "কোন সমস্যা হচ্ছে না তো?"
 
ছোট এক মুজাহিদ বলল, "কয়েকদিন ধরে না খেয়ে আছি। খাবার কিছুই নেই। পেটে শুধু পানি পড়েছে।" সরওয়ার হেসে বলল, "আপনার শুধু পেটের চিন্তা!" তার হাসিটা খুব উদাস মনে হল। জানতে চাইলাম, মেহেরবানি করে সাফ সাফ বলেন পরিস্থিতি কেমন। তিনি জবাব দিলেন, তেমন খারাপও না। এরপর সবাইকেই শহরে যাওয়ার হুকুম দিলেন। আমরা পৌঁছলাম। কিন্তু শহরে সেনা ছাউনি ছাড়া আল বদরের ক্যাম্পগুলো ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। অবশ্য জামায়াতের দফতরের সামনে খন্দক খুঁড়ে দুইটা মোর্চা লাগানো হয়েছিল। যাতে দুশমন বুঝতে পারে যে শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত মোকাবেলা হবে। আমাদের ছাউনিতে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হল। সেখানে আমরা সাত শ আল বদর আর সেনাবাহিনীর সাত হাজার সৈন্য একত্র হলাম।
 
ওখানে পাক আর্মির নওজোয়ান ক্যাপ্টেন অফিসারদের সামনে বক্তব্য রাখলেন। প্রথমে হাতিয়ার রেখে দিতে বললেও কিছুক্ষণ পরেই বললেন, যে যত পার অস্ত্র নিয়ে এয়ারপোর্টে চলে যাও। ওখানে গিয়ে আল বদরের স্বেচ্ছাসেবকদের বলা হল, "যদি বাড়ি যেতে পারো তাহলে চলে যাও। আর সম্ভব না হলে এখানে থাকো।"
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, "এখান থেকে আমরা কোথায় যাব?" কারো কাছে এই প্রশ্নের কোন জবাব নেই। ছিল শুধু অশ্রুর বন্যা আর ফোঁপানি; আর আমরা ছিলাম।

 ৪

"নিজেদের হেফাজত নিজেরা কর"
নীলফামারীর চিলাহাটি থেকে সরতে সরতে দিনাজপুরের খানসামা। বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ের পরও পাক বাহিনীর আচানক পলায়ন। এসবের বর্ণনা দিয়ে আবু আত্তার বলছিলেন-

৩ ডিসেম্বরের আগে থেকেই এখানে ভারতীয় বাহিনীর সাথে যুদ্ধ হচ্ছিল। কিন্তু যেদিন আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধের ঘোষণা হলো সেদিন অবিশ্বাস্যভাবে কোন সংঘর্ষ ছাড়াই পাক ফৌজ চিলাহাটি ছেড়ে দিল। নীলফামারী থেকেও ফৌজ সরিয়ে নিল। পিছু সরতে সরতে অবস্থান নিল দশ মাইল দূরে মাজারগঞ্জে। আচমকাই এসব সিদ্ধান্ত নেয় সেনাবাহিনী। আমাদের সাথে কোন পরামর্শ করেনি। আগের যুদ্ধক্ষেত্রের হিসাবে আল বদর বাহিনী চার মাইল সামনে ছিল। যদিও আমাদের রেজিমেন্ট পাক ফৌজের অধীনেই ছিল। নতুন পরিস্থিতিতে আল বদরের মত সেনাবাহিনীর জওয়ানরাও হতাশ ও নাখোশ ছিল। তারাও এটা বুঝতে পারছিল না, কোন কারণ ছাড়া কেন নিজেদের এলাকা ছেড়ে যাচ্ছে।
 
ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তানে প্রবেশ করে ফেলেছিল। দুই দিন ধরে ওই ফ্রন্টে ব্যারিকেডের মত মোকাবেলা করেছে আল বদর। যদিও আল বদরের কাছে শুধু অটোমেটিক রাইফেল ছিল। লড়ায়ের তীব্রতা বেড়ে গেলে আল বদরকে পিছনে সরে আসার নির্দেশ দিয়ে পাক আর্মি অনেক দূর থেকে গোলাগুলি শুরু করে। আমরা পিছে সরতে সরতে ডোমার থানা চলে আসি। কিন্তু ওখানে কেমন একটা নিস্তব্ধতা ছেয়ে গেল। সাত দিন আমাদের মধ্যে কোন লড়াই হয়নি। মাঝে মাঝে ভারতীয় হেলিকপ্টার চক্কর লাগিয়ে যেত। কিন্তু আমাদের রাইফেল সেগুলোর কিছুই করতে পারত না। আমরা এখনও পাক ফৌজ থেকে তিন মাইল আগে অবস্থান করছিলাম, খানসামায়। অষ্টম দিন ভারতীয় বাহিনী হেলিকপ্টার আর ট্যাংকসহ আল বদরের ওপর হামলা করে। এসময় ক্যাম্পে শুধু ৯৫ জন ক্যাডেট ছিল। এক ঘন্টা ধরে আমরা প্রতিরোধ করি। গাছ-গাছালির কারণে দুশমন আমাদের শক্তি আন্দাজ করতে পারছিল না। ফলে সামনে আগাতে ভয় পাচ্ছিল।
 
এ সময় আমাদের সাথে পাক আর্মি যোগ দেয়। ট্যাংক ফায়ার করলে বড় সংঘর্ষ শুরু হয়। এ যুদ্ধ চলে ২৪ ঘন্টা পর্যন্ত। পরে ভারতীয় ফৌজের জন্য সাহায্য আসে। তবুও তারা প্রতিরোধের মুখে পিছু হটতে বাধ্য হয়। কিন্তু পাক আর্মি আর সামনে এগোল না। এ যুদ্ধে পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সিপাহী বাশারাত অনেক দুঃসাহসের সাথে লড়াই করে। সে অ্যান্টি ট্যাংক চায়না গান দিয়ে দুশমনের দুইটি ট্যাংক ধ্বংস করে। কিন্তু একটা গোলা এসে লাগলে সে শহীদ হয়ে যায়। তার সাথে তিন রাজাকার আর সাত আল বদরও শহীদ হয়। পরের দিন বারোটার দিকে আবার যুদ্ধ শুরু হল। কিন্তু পাক আর্মি কোন কারণ ছাড়াই পিছু সরতে লাগল। তারা ওখান থেকে সাত মাইল পিছনে চলে যায়। আর আল বদর চার মাইল আগে ভারতীয় বাহিনীর মুখোমুখি। তিন দিন পর পাক আর্মি আরও তিন মাইল পিছনে পালিয়ে দারোয়ানি রেলওয়ে স্টেশনে অবস্থান নেয়। পরদিন কর্নেল সাহেব আল বদর কমান্ডারকে ডেকে বললেন৷ "এখন তোমরা নিজেদের হেফাজত নিজেরা কর। আমরা অস্ত্র সমর্পণ করছি।"
 
তিনি কোন জবাবের অপেক্ষাও করেননি। জিপে সাদা পতাকা উড়িয়ে দুশমনের ক্যাম্পের দিকে চলে গেলেন। এবার যেন পাক ফৌজ আগে চলে গেল। আল বদর পিছে থেকে গেল। পাকিস্তান সেনাবাহিনী হেলিকপ্টারের মাধ্যমে ঢাকা রওনা হল। আর আমরা, আল বদর ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলাম। কেউ কেউ হিজরত করলাম।
 
সালিম মানসুর খালিদের 'আল বদর' বই থেকে অনূদিত
Share:

মোস্তফা শওকত ইমরান: যে মৃত্যুযাত্রীর কলিজাতেও ভয় ছিল আধিপত্যবাদীদের


 

১.
"যুদ্ধ শেষের দিকে। একদিন ছাত্রসংঘের দপ্তরে একটা ফোন আসে। অপর পাশ থেকে কথা শুনতে শুনতে মোস্তফা শওকত ইমরান অট্টহাসি দিয়ে উঠলেন। জবাব দিলেন, "জনাব! মরণকে ভয় পাই না। ওকে সামনে দেখেও এভাবেই হাসি, যেভাবে আপনি শুনছেন।" ঘটনা কী, জানতে চাইলাম। জানালেন তার এক আওয়ামী আত্মীয় তাকে ফোন দিয়েছিল। বলে, "তোমার মৃত্যুর সময় খুব কাছে।" এরপর ১৫ ডিসেম্বরের রাত এলো। যে রাত কখনো ভুলবার নয়। দশটার দিকে ঢাকা জামায়াতের আমীর খুররম জাহ মুরাদ সাহেবের ফোন আসে। তিনি বললেন, সিদ্দিক বাজার অফিসে চলে আসো। শওকত ইমরান আমাকে সাথে নিয়ে জিপে রওনা দিলেন। ওখানে পৌঁছতেই খুররম সাহেব বলেন, "সেনাবাহিনী যদিও স্বীকার করছে না, তবে আমার মনে হচ্ছে এরা নিশ্চিত অস্ত্র সমর্পণ করে দিবে।"

তার পরামর্শ নিয়ে আমরা প্রথমে এক সাবেক প্রাদেশিক সভাপতির বাড়ি গেলাম। তাঁর ছেলেমেয়েদের সুরক্ষিত স্থানে রাখার জন্য গেলাম গুলশান এলাকায়। ঘরে ফিরি রাত তিনটায়। ঘরে ফিরেই আমি বললাম, "ইমরান ভাই, আপনি খুব ক্লান্ত। কিছুক্ষণ আরাম করে নিন।" তিনি গা এলিয়ে দিলেন। একই কামরায় আল বদরের আরও কয়েকজন সাথীও ঘুমাচ্ছিল। ফজরের আজান শুনে যেন ঘুম ভাঙলো এক মর্মান্তিক সকালের। নামাজ পড়ার পর ইমরান ভাই আর আমি কর্নেল হিজাযী সাহেবের কাছে গেলাম। তিনি সিভিল পোশাকে জায়নামাজ বিছিয়ে তসবিহ তাহলিল করছিলেন। আমরা তাকে অস্ত্র সমর্পণের খবরের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, "বাবা, ব্রিগেডিয়ার বশির বলতে পারবেন।"

বশির সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, "এরকমই কথা চলছে। আপনারা চাইলে আমাদের সাথে থাকতে পারেন, আমাদের যা পরিণতি হবে তা আপনারাও সইলেন। বাকি সিদ্ধান্ত আপনাদের।" আমরা ওখান থেকে ধানমণ্ডি আল বদর ক্যাম্পে চলে আসি। সবাইকে পরিস্থিতি সম্পর্কে সতর্ক করলাম। এর মধ্যেই খবর পেলাম যে মোহাম্মদপুর থানা থেকে একটা গ্রুপ আমাকে গ্রেফতার করতে আসছে। ইমরান ভাই আমাকে বললেন, "আপনি দ্রুত জিপ নিয়ে এখান থেকে বের হোন।" আমি রাজি হচ্ছিলাম না। কারণ এই মুহূর্তে ঢাকাতে আমাদের ১১টি ক্যাম্পে এক হাজারের বেশি আল বদর ক্যাডেট অবস্থান করছে। তাদের না সরিয়ে আমি কিভাবে সরে যেতে পারি! আমার কথা যেন তিনি শুনলেনই না। বাহু ধরে টেনে জোর করে আমাকে জিপে উঠিয়ে ড্রাইভারকে হুকুম দিলেন, "দ্রুত নিয়ে যান।"

আমি চলে আসার পর ওখানে দায়িত্বশীল শুধু ইমরান ভাই ছিলেন। এরই মধ্যে সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে। ইমরান ভাই পুরো দায়িত্বশীলতার সাথে সকল সাথীকে বিভিন্ন দিকে হিজরত করার জন্য পরামর্শ দিয়ে অন্য ক্যাম্পে রওনা হলেন। কিন্তু রাস্তায় একটা দুর্ঘটনায় উনার হাতে মারাত্মক জখম হয়। খুব কাছেই তার বোনের বাড়ি ছিল। কিন্তু দুলাভাই দোশ নওয়াজ 'ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি'র কর্মী। ওখানে আশ্রয় হলো না। তিনি চলে গেলেন হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে। কিন্তু সেটা তার জন্য সুরক্ষিত ছিল না। কারণ তিনি মেডিকেলেরই শিক্ষার্থী ছিলেন। আর এটাই তার কাল হয়ে দাঁড়াল। হাসপাতালের এক কর্মচারী তাকে চিনে ফেলে, খবর চলে যায় দুশমনের কাছে। কুখ্যাত সন্ত্রাসী ও ন্যাপ-সিপিবি-ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা সংগঠক (পরবর্তীতে ড. কামালের নেতৃত্বাধীন গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক) সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিকের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী তাকে তুলে নেয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলে নিয়ে যাওয়া হলো ইমরানকে। ওখানে মৌলবী ফরিদ আহমদ ও ছাত্র সংঘের কর্মী আজিজুল ইসলামের উপর নির্মম নির্যাতন চালানো হচ্ছিল। দুই দিন ইমরান ভাইকে ওখানেই রাখা হলো। এ সময়ে মৌলবী ফরিদ আহমদ শহীদ হন। তার পরনে শুধু একটা গেঞ্জি আর লুঙ্গি ছিল। নামাজের জন্য যখনই পানি চাইতেন, মুক্তি বাহিনী তাকে পেশাব ভরা গ্লাস ধরিয়ে দিত। ১৮ তারিখ দুশমনরা ইমরান ভাইকে প্রথমে টিএসসি নিয়ে যায়। সেখান থেকে আধা ঘন্টা পর জিপে তুলে নিয়ে যায় হাতিরপুল। এখানে মুক্তিবাহিনীর একটা জটলা ছিল। ইতোমধ্যেই চালানো নির্যাতনের কারণে ইমরান ভাইয়ের মাথায় ক্ষত হয়েছিল। মাথায় বাঁধা রুমালটাও তখন ভেজা, রক্তাক্ত। জিপ থেকে নামাতেই আরেক দফা নির্যাতন শুরু হয়। তার কাছ থেকে জেনারেল রাও ফরমান আলীর জারি করা স্পেশাল পরিচয়পত্র পাওয়া যায়। এ যেন দুশমনের নির্মমতার উনুনে আরও আগুন ঢালে। জুলুমের পরিমাণ ও পদ্ধতি আরও বেড়ে গেল এর ফলে। 

কিন্তু প্রতিটি আঘাতের জবাবেই ইমরান আরও শক্তি নিয়ে বলে উঠছিলেন 'পাকিস্তান জিন্দাবাদ'। তার মুখ থেকে আল বদর সম্পর্কে কোন তথ্য বের করা গেল না। সন্ত্রাসীরা রাগে, উন্মত্ততায় নরপিশাচে রূপ নিল। ব্লেড দিয়ে জখম করে করে গায়ে লবণ মাখানো হলো। তবুও আমানতের হেফাজত করেছেন ইমরান। নির্যাতনের পরিমাণ এত বেড়ে গেছিল যে যেন তার নিশ্বাস কমে আসছে। অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণ হচ্ছিল, গলা শুকিয়ে হয়তো কাঁটা হয়ে যাচ্ছিল। 'পানি' বলে চিৎকার করে উঠলেন তিনি। তার গলার কম্পিত আওয়াজে শয়তান যেন শান্তি পেল। একজন গ্লাসে পেশাব করে তা ইমরানের মুখের কাছে ধরে। তিনি চোখ খুলেই ধাক্কা দিয়ে গ্লাস ফেলে দিলেন। তার কলুষমুক্ত চোখে গুণ্ডাদের এক নজর দেখে ভয়হীন কণ্ঠে আবার বললেন, "পানি"। শয়তানের হাসিতে তার এই আবদারও মিলিয়ে গেল।  

ইমরান ভাই প্রচণ্ড তৃষ্ণায় নিজের বাম হাতের আঙুল মুখে নিয়ে রক্ত চুষতে লাগলেন। কিন্তু মুহুর্তেই তা ফেলে দিলেন। তার চোখ এখন বন্ধ হয়ে আসছে। এক মহিয়ান মঞ্জিলের দিকে তিনি সফর করতে যাচ্ছেন। তার জবান বন্ধ হয়ে আসছে। কিন্তু কোন তথ্যই তিনি দিচ্ছেন না। ফলে প্রমাণিত হচ্ছিল তার বুক ইসলাম ও পাকিস্তানের মুজাহিদদের গোপনীয়তার দুর্গ। তাই এত নিপীড়নের পরও তার এত 'সহজ' মৃত্যু সহ্য হচ্ছিল না আধিপত্যবাদী গুন্ডাদের। তাদের একজন চাকু দিয়ে ইমরানের বুকে 'জয় বাংলা' খোদাই করতে উদ্যত হলো। এই যন্ত্রণায় ঠোঁট কাঁপতে কাঁপতে শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করলেন মোস্তফা শওকত ইমরান। আশহাদু আল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ...
কিন্তু ম্রিয়মাণ এই কালেমার আওয়াজও দুশমনের সহ্য নয়। তার কলেজেরই এক ছাত্রলীগ কর্মী বুকে চাকু দিয়ে গভীর আঘাত করে দুই হাতে বুক চিরে কলিজা বের করে আনে। ইমরানের অযুত সাহসের এই তপ্ত লাভা শুধু মাটিতে ফেলেই ক্ষান্ত হয়নি, পায়ের তলায় পিষ্টও করে সেই আধিপত্যবাদের দোসররা।

ইমরান এভাবে জীবনের বাজি হেরেছেন, কিন্তু ইসলামী আন্দোলনের গৌরবদীপ্ত পথ ছেড়ে দেননি। তার কর্মীদের আর আন্দোলনের গোপনীয়তা জীবন দিয়ে রক্ষা করেছেন। দ্বীন প্রতিষ্ঠার কর্মীদের জন্য দুর্গম দুঃসাহসিক অভিযাত্রায় উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন শহীদ মোস্তফা শওকত ইমরান। ইসলামের ইতিহাসে ত্যাগ আর কুরবানির যে সিলসিলা, তা রক্ষা করেই ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর সন্ধ্যা আরও একবার উজ্জ্বল হলো তার রক্তে।" — তৌফিক ইলাহী
[ নির্যাতনের বিস্তারিত তৌফিক ইলাহীকে জানিয়েছেন ইমরানের উপর নির্যাতনে অংশ নেওয়া মুক্তিবাহিনীর সদস্য ড. জামিল উজ জামান। তিনি আজিমপুরে থাকতেন। ইমরানের শাহাদাত তাকে ইসলামী আন্দোলনের পথ দেখায়। ] 

২.
"১৬ ডিসেম্বর সকালের ঘটনা। ৯টার সময় হতে পারে। যথারীতি দুই-তিন জায়গায় অপারেশনের পরিকল্পনা নিয়ে ক্যাম্প থেকে রওনা হতেই যাচ্ছিলাম। তখন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র সংঘের সভাপতি, ঢাকা সভাপতিসহ মোস্তফা শওকত ইমরান গাড়ি নিয়ে আসলেন। তিনি তথ্য বিভাগের ইনচার্জ ছিলেন। সাথে আরও দুয়েকজন ছিল। তিনি বললেন, "রাতে আমরা ভয়েস অব আমেরিকা আর বিবিসিতে শুনেছি যে পাক ফৌজ অস্ত্র সমর্পণ করে ফেলেছে। চলো, আর্মি হেড কোয়ার্টার থেকে আসল সুরতহাল জেনে আসি।" আমি জবাব দিলাম, আমার কাছে সময় নাই। দুয়েকটা জরুরি কাজ করতে হবে। মনে হচ্ছে অস্ত্র সমর্পণের খবর প্রোপাগান্ডা হবে।

আমার ধারণা এমনটাই ছিল। কিন্তু তারা আমাকে জবরদস্তি আর্মি হেড কোয়ার্টারে নিয়ে গেলেন। প্রথমে কর্নেল হিজাযীর সাথে সাক্ষাৎ হলো। উনি বললেন, ভালো হয় আপনারা ব্রিগেডিয়ার বশির সাহেবের সাথে কথা বলেন।
ব্রিগেডিয়ার বশির সাহেবের সাথে সাক্ষাৎ হলো। তিনি পাক ফৌজ ও আমাদের মধ্যকার লিয়াজো রক্ষার দায়িত্বে ছিলেন। উনি বললেন, রাত আটটার মধ্যে সব কিছু জানা যাবে। মোস্তফা শওকত ইমরান জিজ্ঞাসা করলেন, আপনারা যদি আত্মসমর্পণ করেন তাহলে আমাদের ব্যাপারে কী ভেবেছেন? তিনি জবাব দিলেন, আপনারা সিভিল ড্রেস পরে সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশে যাবেন। অথবা উর্দি পরে আমাদের সাথে অস্ত্র সমর্পণ করতে পারেন। তারপর যা আমাদের সাথে হবে, আপনাদের সাথেও তাই হবে।  কিন্তু আমার ইচ্ছা, আমাদের দুর্ভোগ আপনাদের পোহানোর দরকার নাই। আমি তো এখনও এটা বুঝতে পারছি না যে পাক ফৌজ হিন্দুস্তানিদের সামনে অস্ত্র সমর্পণ করছে!

ইমরান বললেন, আল বদরের একটা সদস্যও এই বেইজ্জতির জন্য প্রস্তুত না। অন্তত আপনারা যে অস্ত্র দুশমনের সামনে জমা দিচ্ছেন, সেগুলো আমাদের দিয়ে দেন। আমরা লড়বো। ব্রিগেডিয়ার সাহেব কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বললেন, আমাদের ক্ষমতাই বা কী! না কোন অর্ডার দিতে পারি, আর না হাতিয়ার। উপর থেকে যে হুকুম হয় তারই তামিল করতে হয় আমাদের। এরপর হেডকোয়ার্টার থেকে আমরা চলে আসি।" — আশরাফুজ্জামান
৩.
"শওকত ইমরান ভাই ছাত্র সংঘের সাথীদের জন্য আপাদমস্তক ইখলাসের উদাহরণ ছিলেন। তার সাথে দুয়েকটি ঘটনা এখনও স্মৃতিতে আছে। এর একটি — ১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে যখন দ্বিতীয় দফায় আমাকে কেন্দ্রীয় সভাপতির দায়িত্ব অর্পণ করা হলো, তখন আমার সমস্যা তিনি কিছুটা বুঝতে পেরেছিলেন। রাত বারোটার দিকে ওষুধ নিয়ে আমার রুমে চলে আসলেন। যেহেতু উনি ডাক্তার ছিলেন, জানতেন যে আমি মানসিকভাবে পেরেশান থাকলে আমার ঘুম হয় না। তিনি সম্মেলন কেন্দ্রের ইনচার্জ ছিলেন। কিন্তু সমস্ত দায়িত্ব পূরণ করার পরও নিজে আরাম করলেন না। আমার খেয়াল না রেখে নিজে ঘুমানোর প্রস্তুতি নেননি।

বিভিন্ন সম্মেলন বা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোর দায়িত্ব যাদের উপর অর্পিত হতো — শহীদ আব্দুল মালেক, শহীদ শাহ জামাল, শহীদ শওকত ইমরানকে দেখেছি, কর্মসূচি  বাস্তবায়নের জন্য দিনরাত কাজ করতেন। এত দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়েও মেজাজের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল। সব কাজ নিজে এগিয়ে এসে করতেন। শাহ জামাল ভাই মেঝেতে বসে বসে কাজ করিয়ে নিতেন। কিন্তু আব্দুল মালেক ও শওকত ইমরান সম্মেলন কেন্দ্রের ইনচার্জ কিংবা সম্মেলনের সভাপতি হয়েও ছোট ছোট কাজ নিজে করে ফেলতেন।" — শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী 

৪.
শওকত ইমরান ফেনী শহরে এক বিত্তবান পরিবারে জন্ম নেন। শৈশব থেকেই তিনি নম্র-ভদ্র হিসাবে বেড়ে উঠেছিলেন। কিন্তু বাবা ছিলেন আওয়ামীলীগ নেতা। ফলে ঘরে রাজনীতি চর্চা হওয়ায় তখন থেকেই দুর্বার সাহসীও হয়ে ওঠেন শওকত ইমরান। স্কুল জীবন থেকেই বিভিন্ন বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় অংশ নিতেন। পরবর্তীতে মেডিকেল শিক্ষার্থী হলেও ইতিহাসের উপর তার অসামান্য দক্ষতা ছিল। 

স্কুল জীবনেই ছাত্র সংঘের দাওয়াত পেয়েছিলেন তিনি। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার পর ভর্তি হন ঢাকা মেডিকেল কলেজে। ইচ্ছা ছিল এম.বি.বি.এস করবেন। এখানে এসে ইসলামী ছাত্রসংঘে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ৩০ এপ্রিল ১৯৬৮ সদস্য হওয়ার জন্য আবেদন করেন। চার মাস সদস্য প্রার্থী থাকার পর নভেম্বরে সদস্য হন। ১৯৬৯ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংঘের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। একই বছর প্রথমে প্রাদেশিক শুরা সদস্য এবং পরের বছর কেন্দ্রীয় শুরা সদস্য হিসাবে নির্বাচিত হন তিনি। সর্বশেষ প্রাদেশিক তথ্য শাখার দায়িত্বে ছিলেন। যুদ্ধ চলাকালে ঢাকা আল বদরের তিনটি কোম্পানিতেই তিনি কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

শহীদের পরিবার আওয়ামী রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত থাকায় মাওলানা আবুল আ’লা মওদূদী ও অধ্যাপক গোলাম আযমের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করতেন। বাবা টাকার গরমে ছেলেকে জামায়াতের থেকে কিনেও নিতে চেয়েছিলেন। একবার মোস্তফা শওকত ইমরানকে চিঠি পাঠিয়েছিলেন, "মোস্তফা, মাওলানা মওদূদী তোমাকে কত টাকায় কিনেছে? তুমি যদি মওদূদী আর গোলাম আযমের ক্রীতদাস হয়ে থাকো, তাহলে আমি প্রতিটি উপায়ে তোমাকে মুক্ত করতে চাই। নিজের সমস্ত সম্পত্তি বিক্রি করে, এমনকি নিজের শরীরের চামড়া দিয়ে জুতা বানিয়ে হলেও তোমাকে গোলামী থেকে মুক্ত করতে চাই।"

এসব কারণে শওকত ইমরান পরিবারের চিঠি এড়িয়ে যেতেন। ঘন ঘন বাড়ি যাওয়াও তার পছন্দ ছিল না। তৌফিক ইলাহী চিঠির ব্যাপারটা খেয়াল করে তাকে পড়ার জন্য চাপ দিতে থাকেন। তখন তিনি নিজেই চিঠি খুলে তৌফিক ইলাহীকে পড়তে দেন। উপরোক্ত চিঠি পড়ার পর তৌফিক বুঝতে পারেন পরিস্থিতি। শওকত ইমরান তখন বলেন, "আমি আব্বা-আম্মার সাথে বেয়াদবি করতে চাই না। এ জন্য চিঠি খুলে দেখি না। সবর করি। কারণ, মনে হয় এই চিঠিগুলো আমাকে আব্বা-আম্মার নাফরমানি করাবে। অথবা সরিয়ে দিবে ইসলামী আন্দোলন থেকে।" শাহাদাতের পর মোস্তফা শওকত ইমরানের বাবা ও ছোট ভাই ইসলামী আন্দোলনে যুক্ত হন। 

📖 সালিম মানসুর খালিদের 'আল বদর' বই থেকে অনূদিত

মূল পোষ্ট: Facebook

Share:

৭১ এ কি ঘটেছিল রাজাকার কারা ছিল - খন্দকার আবুল খায়ের (রহ)

৭১ এ কি ঘটেছিল রাজাকার কারা ছিল বইয়ের পিডিএফ লেখক খন্দকার আবুল খায়ের (রহ)
খন্দকার আবুল খায়ের (রহ) এর "৭১ এ কি ঘটেছিল রাজাকার কারা ছিল"  বই এর পিডিএফ 

খন্দকার আবুল খায়ের (রহ) বাংলাদেশের প্রথিতযশা মরহুম আলেমদের মধ্যে একজন। তিনি তার দরসে কোরআন সিরিজের জন্য  বিখ্যাত। তিনি ৪৬ এর কলকাতা দাঙ্গা, পাকিস্তান ভাগ এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের একজন প্রত্যক্ষ সাক্ষী। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি যশোর এলাকায় জামায়াত ইসলামের দায়িত্ব পালন করেছেন। একজন আলেম হওয়ায় তিনি তাফসির মাহফিল করতেন যেহেতু তিনি একাত্তরের প্রত্যক্ষদর্শী জামায়াত নেতা তাই যেখানে যেতেন সেখানেই এই বিষয়ে কিছু প্রশ্নের সম্মুখীন হতে। এই কমন প্রশ্ন গুলোকে একত্রিত করে নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি একটি বই লিখেন। যেটি তার সাওয়াল জওয়াব সিরিজের চতুর্থ খন্ড হিসেবে প্রকাশিত হয়।

“৭১ এ কি ঘটেছিল রাজাকার কারা ছিল” এই বইটি একটি ঐতিহাসিক দলিল। আসলে একাত্তরে জামায়াতে ইসলাম কি করেছিল, তাদের ভুমিকা কেমন ছিল, জামায়াতে ইসলাম বা জামায়াতে ইসলামের নেতৃবৃন্দ উপরে যে অভিযোগগুলো করা হয় এর সত্যতা কতটুকু এই বিষয়গুলো লেখক বইটিতে নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে তুলে ধরা হয়েছে। 


বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর এর নতুন কোন সংস্করণ না বাজারে না আসায় বই কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গিয়েছে। আমাকে এক ভাই বলেছেন যে উনি উক্ত প্রকাশনীতে গিয়েও বইটির একটি কপি সংগ্রহ করতে পারেনি। আলহামদুলিল্লাহ আমার কাছে এক কপি ছিল সেই বইটির। আমি বইটির পিডিএফ করেছি আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করার জন্য। আশা করি আপনারা শেয়ার করে বইটি  কাছে ছড়িয়ে দেবেন। বর্তমান সময়ে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা ৭১ নিয়ে চিন্তার জায়গায় যে দোলাচলে ভুগছে এই বইটি। তাদের সঠিক পথ দেখাবে বলে আশা করছি।


ডাউনলোড পিডিএফ:

১. Link (Archive)

২. Link (Drive)

Share:

হাকেমিয়্যাতঃ মাওলানা মওদূদী [রহ.]

হাকেমিয়্যাতঃ মাওলানা মওদূদী [রহ.] 

মাওলানার হাকেমিয়্যাত দর্শন নিয়ে আলোচনার আগে কুরআন থেকে একটা বিষয় দেখে নেয়া জরুরি। কুরআনে মানুষের সফলতা ও মানুষের বিফলতার ২ টি দিক বলা হয়েছে। কয়েকটি আয়াত উল্লেখ করলে তা স্পষ্ট হয়ে যায়। 

এক. কারা বিফল?

আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল কোনো বিষয়ে ফয়সালা দেয়ার পর সে ব্যাপারে কোনো মু’মিন নারী পুরুষের কোনো ক্ষমতা নেই তাঁর বিপরীতে কথা বলার। কথা বললেই সে বিফল অর্থাৎ সে গোমরাহীতে নিমজ্জিত।– আহযাব ৩৬ 

যারা বলে আমরা আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের উপর ঈমান এনেছি । এবং আনুগত্য কবুল করেছি। কিন্তু তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়। এরা মু’মিন নয়। নূর ৪৭-৪৮ 

দুই. কারা সফল?

যখন তাঁদের মধ্যে ফয়সালা করা হবে আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে এবং এদিকে আহবান করা হবে তখন তারা বলবে, আমরা শুনেছি এবং আনুগত্য করেছি। এটা ঈমানদারদের কাজ। এবং এরাই সফল। - নূর ৫১ 


যদি উপরের দুটি আয়াত ভালোভাবে খেয়াল করি { আরোও অসংখ্য আয়াত আছে সব আয়াত একসাথে দেয়া সম্ভব নয় বিদায় এই আয়াতগুলো দিয়েই বললাম ।} তাহলে দেখবো যে, পৃথিবীর যেকোনো বিষয়, যেকোনো দিক ও যেকোনো বিভাগ নিয়ে ফয়সালা বা সিদ্ধান্ত দেয়ার একমাত্র মালিক, একমাত্র ক্ষমতাধর ও একমাত্র অথরিটি হলেন আল্লাহ ও তাঁর রাসূল। মাওলানা মওদূদী এটাকে বলেছেন, ‘উর্ধ্বতন আইন’ বা SUPREME LAW . তিনি বলেছেন এই আইন এমন এক নিরঙ্কুশ ক্ষমতাধর যার মোকাবিলায় ঈমানদার ব্যক্তি শুধুই আনুগত্য করবেন। 

এই আইনের বিরোধিতাকারীকে বলা হয়েছে কাফের, মুশরেক ,যালেম, গোমরাহী এবং সীমালঙ্ঘনকারী। আর এই আইনের অধীনে ,এই আইনের গণ্ডীতে এবং এই আইনের সীমারেখায় থাকা ব্যক্তিকে বলা হয়েছে ,সফল ,ঈমানদার ও আনুগত্যপরায়ণ।

 সুতরাং আমাদের কাছে একথা একেবারেই পরিষ্কার যে, হুকুম দিবার ও প্রভুত্ব ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার আল্লাহ ছাড়া আর কারও নয়। তিনি আদেশ করেছেন সর্বক্ষেত্রে একমাত্র তাঁরই দাসত্ব ও আনুগত্য করতে হবে আর এটাই সঠিক পথ- বাকী সব পথ ও মত বাতিল এবং পরিত্যাজ্য। এই যে, হুকুম দিবার ও ক্ষমতা প্রয়োগ করার একচ্ছত্র মালিক আল্লাহ- এরই নাম হলো ‘’আল্লাহর হাকেমিয়্যাত বা আল্লাহর সার্বভৌমত্ব’’। 

‘’হাকেমিয়্যাত’’- শাসন কর্তৃত্ব ,প্রভুত্ব ,একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী,উচ্চতর ক্ষমতা, নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব ও আধিপত্য অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। 

অনেক বোদ্ধা পণ্ডিত ব্যক্তিত্ব বলে থাকেন যে, মাওলানা মওদূদিই নাকি প্রথম যিনি আল্লাহর সার্বভৌমত্ব বা হাকেমিয়্যাত নিয়ে কথা বলেছেন। এই কথাটা সত্যি নয়। একবিংশ শতাব্দির মুজতাহিদ , আল উস্তাদ আল ইউসুফ আল কারযাবি (আল্লাহ হেফাযতে রাখুন) তাঁর ‘’মিন ফিকহী আদ দাওলাহ ফিল ইসলাম’’ গ্রন্থে বলেছেন যে, ‘’উসুলে ফিকহ শ্রাস্ত্রের ভূমিকায় উসুলবিদগণ শরীয়তের ‘হুকুম’ তথা বিধি-বিধান ,’হাকেম’ তথা আইন প্রণেতা ও ‘’মাহকুম আলাইহি’’ বা শাসিত এবং ‘’মাহকুম বিহি’’ তথা সংবিধান ইত্যাদি বিষয়ের আলচনা করতে গিয়ে ‘হাকেমিয়্যাত’ তথা শাসন কর্তৃত্বের বিষয়টি সম্পর্কেও আলোচনা করেছেন। ইমাম আবু হামিদ আল গাজালী রহ. তাঁর প্রসিদ্ধ কিতাব ‘‘আল মুসতাসফা মিন ইলমিল উসুল’’ গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে ‘হুকুম’ এর আলোচনা করতে গিয়ে বলেন ; হুকুম হচ্ছে মূলত শরিয়াহর প্রণেতার আদেশ। এরপর তিনি বলেন, হাকেমের আলোচনায় একথা সুস্পষ্ট যে, আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউ হুকুম দেয়ার অধিকার রাখেনা।‘’[ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা তত্ত্ব ও প্রয়োগ, ইউসুফ আল কারযাভী ,বিআইআইটি] 

মাওলানা মওদূদী রহ. এর  ভাষায়,ইসলামে সার্বভৌমত্ব নির্ভেজালভাবে একমাত্র আল্লাহ তা'আলার জন্য। কোরআন মাজীদ তৌহিদের আকিদায় যে ব্যাখ্যা করেছে তার আলোকে মাওলানা বলেন, এক ও অদ্বিতীয় ‘লা শরীক আল্লাহ’ কেবল ধর্মীয় অর্থেই মা'বুদ নয়,বরং রাজনৈতিক এবং আইনগত অর্থের দিক থেকেও তিনি একচ্ছত্র অধিপতি, রাজা, ক্ষমতাবান ও কতৃত্বশীল। তিনিই আল্লাহ যিনি একমাত্র আদেশ-নিষেধের অধিকারী এবং আইন প্রণয়নকারী। আল্লাহ তা'আলার এই সার্বভৌমত্ব কে তিনি "Legal Sovereignty" হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

তিনি বলেন, ইসলাম আল্লাহর এই ‘আইনগত সার্বভৌমত্ব’ ততটাই জোরের সাথে পরিষ্কারভাবে পেশ করে যতটা জোরের সাথে এবং পরিষ্কারভাবে পেশ করে তাঁর ধর্মীয় সার্বভৌমত্বের আকিদা। মাওলানার দৃষ্টিতে আল্লাহর এই দুই ক্ষমতা আল্লাহর উলুহিয়্যাতের অবশ্যম্ভাবী ফল। একটি থেকে অপরটিকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। যদি ধর্মীয় আকিদা কে গ্রহণ করে বা বেশি জোর দিয়ে অপরটিকে অর্থাৎ রাজনৈতিক ও তামুদ্দনিক আকিদা কে কম জোর বা অস্বীকার করা হয় তাহলে তা ‘আল্লাহর উলুহিয়্যাতে’ অস্বীকার করারই নামান্তর। 

তাছাড়া তিনি মনে করেন, ‘ইসলাম এরূপ সন্দেহ করার কোনো অবকাশ রাখেনি যে , খোদায়ী কানুন বলতে শুধু প্রাকৃতিক বিধানকে বুঝানো হয়েছে। বরং মানুষ তাঁর নৈতিকতা ও বিবেকবোধ দিয়ে যা অনুভব করে ,সামাজিক জীবনে চাল-চলনের ক্ষেত্রে যে ধরনের নিয়মের মধ্যে দিয়ে তাঁকে চলতে হয়—এর সবকটা জায়গায়ই মানুষ আল্লাহর সেই শরঈ আইন স্বীকার করে নেবে যা তিনি তাঁর নবীদের মাধ্যমে পাঠিয়েছেন।‘ সুতরাং আইন মান্য করা ও সব স্তরে আল্লাহর আইনকে প্রাধান্য দেয়ার নামই আল্লাহর উলুহিয়্যাতে বিশ্বাস করা। 

এই যে নিজের স্বাধীন সত্তাকে আল্লাহর অধীনে বিলিয়ে দেয়া, নিজের ইচ্ছা-শক্তি ,চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা, দৃষ্টিভঙ্গি ও আচার-ব্যবহার, কথাবার্তা ইত্যাদিকে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের নিকট বিলিয়ে দেয়া। এরই নাম মাওলানা দিয়েছেন- ইসলাম বা সারেন্ডার (Surrender)। হাকিমিয়্যাহ অর্থাৎ সুপ্রিম আইনের উপরে কোনো বিকল্প আইন হতে পারেনা। সুপ্রিম আইনের মোকেবেলায় একমাত্র সেই আইনের প্রতি শর্তহীন আনুগত্য দেখাতে হয়।

তারপর তিনি মূল সূত্র কোরআনের সাহায্যে পেশ করেন। তিনি বলেন, সমাজের ,রাষ্ট্রের যেসব ক্ষেত্রে তা রাজনৈতিক হোক, কি পররাষ্ট্রনীতির হোক- যুদ্ধক্ষেত্রে হোক-সন্ধি বা চুক্তি,মিছিল বা জন সমাবেশ, ইবাদাত বা দোয়া ,সাংগঠনিক কাজেই হোক আল্লাহ ও তাঁর রাসুল যা ফয়সালা দিয়েছেন সেসব ক্ষেত্রে কোনো মানুষের ফয়সালা করার অধিকার নাই। তিনি এই সূত্রের আইনত রেফারেন্স হিসেবে কোরআনে বর্ণিত এই আয়াতটি গ্রহণ করেছেন।

আল্লাহ বলেন,"আল্লাহ এবং তাঁর রাসুল যখন কোনো ব্যাপারে ফয়সালা করে দেন, তখন কোনো মুমিন পুরুষ এবং কোন মুমিন স্ত্রীলোকের নিজেদের সেই ব্যাপারে ভিন্নরূপ ফয়সালা করার অধিকার নেই। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের অবাধ্যতা করে সে নিশ্চয়ই সুস্পষ্ট গোমরাহীতে লিপ্ত হলো"। 

নৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আল্লাহর প্রভুত্বের হিসাব নিকাশের পর এবার মাওলানা বলেন, তাহলে এই পৃথিবীর ভূখন্ডের সার্বভৌমত্ব কার হাতে থাকবে? 

সাবধান! সৃষ্টি তাঁর ,নির্দেশও তাঁরই – সূরা আল আরাফ

তারা বলে, আমাদেরও কি কোনো ইখতিয়ার আছে? বলো, সমস্ত ইখতিয়ার আল্লাহরই।– সূরা আলে ইমরান 

চোর- নারী পুরুষ উভয়ের হাত কেটে দাও- তুমি কি জান না যে, আসমান জমীনের সব বাদশাহী আল্লাহরই জন্য।– সূরা আল মায়েদা। 

তোমাদের মধ্যে যে মতভেদই হোক না কেন, তাঁর ফয়সালা করা আল্লাহর কাজ।– সূরা আশ শুয়ারা। 

শাসন কর্তৃত্ব আল্লাহ‌ ছাড়া আর কারোর নেই। তাঁর হুকুম- তোমরা তাঁর ছাড়া আর কারোর বন্দেগী করবে না। এটিই সরল সঠিক জীবন পদ্ধতি, কিন্তু অধিকাংশ লোক জানে না। সূরা ইউসুফ। 

মাওলানা মওদূদী রহ. সার্বভৌমত্বের আলোচনায় এক পর্যায়ে বলেন, পৃথিবীর কোনো মানুষই আল্লাহর এই সার্বভৌমে অস্বীকার করেনা। কাফের-মুশরেকরাও করতো না। এই কথার অসংখ্য দলিলও কুরআনে রয়েছে। তাহলে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের সাথে মানুষ বা রাষ্ট্রের বিরোধ কোথায়? তিনি বলেন বিশ্বভূবনের মালিক কে- এই প্রশ্নে কোনো বিরোধ নাই। কিন্তু নির্দিষ্ট করে যদি বলা হয় যে, এই ভূখন্ডের মালিক কে? যেমন, বাংলাদেশের মালিক কে? তখনি মূলত বিরোধ শুরু হয়। ইসলামের দৃষ্টিতে নিখিল বিশ্বের মালিক যেমন আল্লাহ-এই বাংলাদেশের মালিকও তেমনি- আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা ।

Share: