১৯৭০ সালের জানুয়ারি মাস, পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্র সংঘের প্রাদেশিক কনফারেন্সের ঘোষণা দেওয়া হয়। প্রায় তিন হাজার ডেলিগেট ও মেহমানের খাবারের দায়িত্ব আমার উপর ছিল। কিন্তু সময়ের আগে খাবার প্রস্তুত করতে পারিনি। সে সময়ে ইলিয়াস এসে জিজ্ঞাসা করলেন, খাওয়া প্রস্তুত হয়নি কেন? আমি বললাম, ধারণার চেয়ে অনেক বেশি লোক চলে এসেছে। বললেন, আমি ব্যবস্থা করছি। তিনি বেশ ভালো স্বাস্থ্য ও শরীরের অধিকারী ছিলেন। বললাম, "শুধু শরীর থাকলেই হবে না, দক্ষতা লাগবে এ কাজে।" তিনি জবাব দিলেন এভাবে, "দশ জনের কাজ একাই করবো, হবে না কেন?" এরপর তিনি কাজে ডুব দিলেন। দ্বিতীয় দিন পল্টন ময়দানে মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীর (রহ.) বক্তৃতা ছিল। কিন্তু আওয়ামী গুন্ডাবাহিনী সভা পণ্ড করে দেয়। আমাদের কয়েকজন লোক জখম হয়। শহীদ হয় কয়েকজন। আহতদের মধ্যে ইলিয়াস ছিলেন।
শহীদ ইলিয়াসের শাহাদাতের হৃদয়বিদারক ঘটনা ইসলামী আন্দোলনের ত্যাগ ও কুরবানির এক প্রেরণাদায়ক ইতিহাস
জামায়াত কি স্বজাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল?
এ জমিনের সুরক্ষা সেভাবে করতে হবে যেভাবে মসজিদের সুরক্ষা করা হয়
আল বদরের শহীদদের সংক্ষিপ্ত একটি তালিকা
ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্য প্রার্থী এবং নোয়াখালী সরকারী কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি ছিলেন। স্কুলে পড়াশোনাকালে একদিন রাস্তায় স্থানীয় দায়িত্বশীল আবু নাসিরের সঙ্গে দেখা হয়। তিনি জানতে চান 'আপনারা সব সময় কী কাজ করেন? আমাকেও বলেন। আমিও করতে চাই।' রাস্তার এই পরিচয় তাকে সিরাতুল মুসতাকিমের রাহী বানায় এবং সেই পথে চলতে চলতে ডিসেম্বরে শাহাদাতের মঞ্জিলে পৌঁছে যান।
২. শহীদ আবু তাহের আনসারী:
৩. শহীদ আনওয়ার হোসাইন:
আনওয়ার
হোসাইন মাত্র ১৪ বছর বয়সে শাহাদাত হাসিল করেছেন। তিনি তখন নরসিংদী মডেল
স্কুলের ছাত্র। বাবা তাফাসসুল হোসাইনের নির্দেশে ছাত্র সংঘে শামিল হন। কয়েক
মাসের মধ্যেই একাত্তরের রক্তাক্ত পরিস্থিতি শুরু হয়। তিনি প্রথমে রাজাকার
ফোর্সে অংশ নেন। পরে আল বদর গঠন হলে সেখানকার সক্রিয় মুজাহিদ হয়ে ওঠেন।
ডিসেম্বরে
পাকিস্তানি ফৌজ পশ্চাৎপদ হলে বাবা-মাকে নিয়ে নৌকাযোগে তিনি বৈদ্যমারা
যাচ্ছিলেন। এমন সময় মুক্তিবাহিনীর গুণ্ডাদের হাতে পড়ে যান। হাত-পা বেঁধে
স্থানীয় একটি স্কুলে নিয়ে সারারাত মায়ের সামনেই নির্মম নির্যাতন চালানো হয়
তার ওপর। এরপর ছুরির আঘাতে আঘাতে ক্ষতবিক্ষত দেহটি মেঘনার স্রোতে ভাসিয়ে
দেওয়া হয়। নির্মম নিপীড়নে মায়ের হাড্ডিও ভেঙে দেয় মুক্তিবাহিনীর গুণ্ডারা।
আজও সেই ভাঙা হাঁড় থেকে মমতার কণ্ঠ শোনা যায়। ঘরের প্রদীপই নিভিয়ে দেয়নি
শুধু, গুণ্ডারা তাদের বাড়িটিও লুটপাট করে বিরান করে ফেলে।
৪. শহীদ মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম:
রাজশাহী
ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের শিক্ষার্থী মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম ছাত্র সংঘের সাথী
এবং শহরের রানীনগর আবাসিক শাখার ইনচার্জ ছিলেন। আল্লাহ তায়ালা তাকে চমৎকার
সাংগঠনিক দক্ষতা দান করেছিলেন। বাগ্মী ছিলেন, ছিলেন সাহিত্যিকও।
হিন্দুস্তানী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জান উৎসর্গ করে খিদমত আঞ্জাম দিয়ে
যাচ্ছিলেন। মুক্তিবাহীনীর চোখে তিনি হয়ে উঠেছিলেন আতঙ্কের নাম। ঢাকার পতন
হলে ১৭ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী তাকে ধরে ফেলে। নির্যাতন করতে করতে তাকে শহীদ
করে পদ্মায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়।
৫. শহীদ নুরুজ্জামান:
দ্বিতীয়
বর্ষের ছাত্র এবং সংঘের সাথী। শাহাদাতের দুই দিন আগে এক সঙ্গীর মাধ্যমে
বাবাকে চিঠি পাঠিয়েছিলেন। লিখেছিলেন, আমি আল্লাহর রাহে জিহাদ করছি। দুয়া
করবেন, যেন শাহাদাতের মৃত্যু নসিব হয়। এটি সেই মৃত্যু, খালিদ বিন ওয়ালিদের
(র.) মত জেনারেলরা যার কামনা করেছিলেন। নুরুজ্জামানের এই তামান্না
পূরণ হয়। শাহ জালালের সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরে দায়িত্ব আঞ্জাম দিতে গিয়ে
ভারতীয় বিমান হামলায় শহীদ হয়ে যান তিনি।
৬. শহীদ মুহাম্মদ ইসমাইল:
নোয়াখালীর
টুমচর বেশ কয়েকজন শহীদকে জন্ম দিয়েছে। তার একজন মুহাম্মদ ইসমাইল। তার বাবা
মাওলানা হাফিজুল্লাহ টুমচরে মাদ্রাসা শিক্ষক ছিলেন। অতিরিক্ত লম্বা আর
স্বাস্থ্যে দুর্বল ছিলেন ইসমাইল। ম্যাট্রিকের সময় তিনি সংঘের কর্মী হন।
প্রথম বর্ষে ভর্তি হন আল বদরে। বিভিন্ন স্থানে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
ডিসেম্বরে শত্রু যখন বিজয়ী হয়, তখন তাকে গ্রেফতার করে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া
হয়। তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তখন তার বয়স হয়েছিল ১৮ বছর।
৭. শহীদ আমিনুল ইসলাম:
জামালপুরের
সবচেয়ে ক্রিয়াশীল এবং অস্ত্রচালনায় তুখোড় মেধাবী আমিনুল ইসলামের বাড়ি ছিল
মধুপুরে। ছাত্র সংঘের সাথী ছিলেন। হয়েছিলেন আল বদরের কোম্পানি কমান্ডার। ১৪
ডিসেম্বর ঢাকার দিকে মার্চ করেন। মিরপুর পৌঁছানোর পর মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে
সংঘর্ষ হয়। ওই লড়াইয়ে তিনি শাহাদাতের পেয়ালা পান করেন।
৮. শহীদ ইসমাইল হোসাইন:
কুষ্টিয়ার
আলিয়া মাদ্রাসা থেকে পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে শেষ বর্ষের ছাত্র ছিলেন। ১৯৬৫ তে সংঘের কর্মী এবং ৭১
সালে সদস্য হন। ঢাকার আইয়ুব কলোনীর তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। ইসলামী আন্দোলনের
সুপরিচিত এই যুবক ছিলেন কবি। পুনরুত্থান ও রাহবার সহ তিনটি রচনা প্রকাশ
পেয়েছিল। বিষয়ের দিক থেকে তার গদ্য ছিল ইতিহাস ও রাজনীতি বিষয়ক। আল বদরের
এক জাগ্রত বিবেক মুজাহিদ ছিলেন তিনি। বাঙালি ও বিহারীদের মধ্যে এক মিশনে
গিয়েছিলেন। বিহারীরা তাকে শহীদ করে।
৯. শহীদ আব্দুস সাত্তার:
কুষ্টিয়ার
কুমারখালীর শহীদ আব্দুস সাত্তার। বাবা আযহার আলী সাহেব ১৯৭০ সালে ইন্তেকাল
করেন। কুমারখালী এমএন হাই স্কুলে দশম শ্রেণির ছাত্র থাকা কালেই একজন
দায়িত্বশীল কর্মী হিসাবে ছাত্র সংঘে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন সাত্তার। আল বদরে
অংশ নিয়ে প্রশিক্ষণ নেন। কুষ্টিয়ার পতনের পর তার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না।
অনুমান করা হয় মুক্তিবাহিনীর হাতে তিনি শহীদ হয়েছেন। তিনি তখন ১৭/১৮ সালের
কিশোর ছিলেন।
১০. শহীদ মুহাম্মদ ইলিয়াস:
নোয়াখালীর আহমদপুরে জন্মগ্রহণ করেন। ছাত্রজীবনে ইসলামী ছাত্র সংঘ করতেন। মিছিলে সবার আগে স্লোগান দেওয়া, দাওয়াতি এবং প্রচারণামূলক পোস্টার নিজে প্রস্তুত করে বিভিন্ন জায়গায় লাগানোর জন্য তাকে জানত না এমন কেউ নেই। পড়াশোনা শেষ তখন দু বছর হয়েছে। এক বছর আগে বিয়েও করেছেন। এমন সময় মাতৃভূমির আহ্বানে তিনি ঘর-সংসার ত্যাগ করে আল বদর ক্যাম্পে চলে আসেন। প্রশিক্ষণ নিয়ে দায়িত্ব আঞ্জাম দেওয়া শুরু করেন। ৭ ডিসেম্বর তিনি শত্রুদের হাতে বন্দি হন। তার ঈমানের পরীক্ষা শুরু হয়ে গেল। আহমদপুর পর্যন্ত তার উপর লাঠি বর্ষণ হতে থাকে। লাঠির আঘাতেই তাকে শহীদ করা হয়। আহমদপুরে নিজ বাড়ির সামনে তার কবর রয়েছে। শাহাদাতের সময় তার বয়স হয়েছিল ২৫।
১১. শহীদ মুহাম্মদ কামাল:
মেডিকেল কলেজের এই ড্রাইভার আপাদমস্তক ছিলেন একটি আন্দোলন। ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্ক, ইবাদতে মশগুলিয়াত আর সংঘের কর্মীদের স্নেহ তার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। মিছিল আর সমাবেশ আয়োজন ও এন্তেজামে স্ব-ইচ্ছায় এগিয়ে আসতেন, সব সময় ছিলেন অগ্রগামী। ১৬ ডিসেম্বর তার গ্রাম থেকে মুক্তি বাহিনী তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। তাকে শহীদ করে পদ্মায় ফেলে দেওয়া হয়। তখন তার বয়স হয়েছিল ২৭ বছর
১২. শহীদ আবুল কালাম:
শহীদ
আবুল কালাম নোয়াখালীর শোলাখালীতে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা তাজুল ইসলাম ছিলেন
কৃষক। ফেনী কলেজে ভর্তি হওয়ার পর আবুল কালাম ইসলামী ছাত্র সংঘে শামিল হন।
লেখালেখি এবং বক্তৃতার দক্ষতা আল্লাহ তাকে অনেক দিয়েছিলেন। ইতিহাসের প্রতি
তার গভীর অনুরাগ ছিল। ১৯৭১ সালে আল বদরে শামিল হন। ৮ ডিসেম্বর তাকে কাজী
বাজার থেকে ধরে ফেলে শত্রুরা। কাছেই একটি কামারের কাছে নিয়ে গিয়ে তার শরীরে
ছ্যাঁকা দেয় তারা। তার শরীর ক্ষত-বিক্ষত হতে থাকে। বইতে থাকে রক্তের
স্রোত। কাছেই মুক্তিগঞ্জে একটি গাছে উল্টা ঝুলিয়ে রাখা হয়। এ অবস্থায় ৯
ডিসেম্বর তিনি এই নশ্বর দুনিয়া ত্যাগ করেন।
১৩. শহীদ মুহাম্মদ সোহরাব আলী:
মুহাম্মদ
সোহরাব আলীও কুমারখালীর ছিলেন। বাবা ইমান আলী সুতার ব্যবসা করতেন। নবম
শ্রেণিতে থাকতে তিনি ছাত্র সংঘে সম্পৃক্ত হন। ১৯৭১ সালে জেএন হাই স্কুলে
দশম শ্রেণির ছাত্র এবং সংঘের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। এ সময়ই আল বদরে শামিল হন।
পাক ফৌজের পরাজয়ের পর পলাতক অবস্থায় মুক্তিবাহিনীর হাতে আটক হন। তাকে ২২
ডিসেম্বর অকথ্য নির্যাতনের মাধ্যমে শহীদ করা হয়।
"আমাদের শহীদেরা সবচেয়ে বড় সম্পদরেখে গেছে সাহসের দ্বিধাহীন সোজা রাজপথ"
বেদনার উপাখ্যান: কাদিয়ানি সেনা কর্মকর্তার প্রতিহিংসার শিকার শহীদ শাহ জামাল ও আব্দুস সালাম
ঢাকা পতন: সালিম মানসুর খালিদের 'আল বদর' বই থেকে
৪
মোস্তফা শওকত ইমরান: যে মৃত্যুযাত্রীর কলিজাতেও ভয় ছিল আধিপত্যবাদীদের
তার পরামর্শ নিয়ে আমরা প্রথমে এক সাবেক প্রাদেশিক সভাপতির বাড়ি গেলাম। তাঁর ছেলেমেয়েদের সুরক্ষিত স্থানে রাখার জন্য গেলাম গুলশান এলাকায়। ঘরে ফিরি রাত তিনটায়। ঘরে ফিরেই আমি বললাম, "ইমরান ভাই, আপনি খুব ক্লান্ত। কিছুক্ষণ আরাম করে নিন।" তিনি গা এলিয়ে দিলেন। একই কামরায় আল বদরের আরও কয়েকজন সাথীও ঘুমাচ্ছিল। ফজরের আজান শুনে যেন ঘুম ভাঙলো এক মর্মান্তিক সকালের। নামাজ পড়ার পর ইমরান ভাই আর আমি কর্নেল হিজাযী সাহেবের কাছে গেলাম। তিনি সিভিল পোশাকে জায়নামাজ বিছিয়ে তসবিহ তাহলিল করছিলেন। আমরা তাকে অস্ত্র সমর্পণের খবরের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, "বাবা, ব্রিগেডিয়ার বশির বলতে পারবেন।"
বশির সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, "এরকমই কথা চলছে। আপনারা চাইলে আমাদের সাথে থাকতে পারেন, আমাদের যা পরিণতি হবে তা আপনারাও সইলেন। বাকি সিদ্ধান্ত আপনাদের।" আমরা ওখান থেকে ধানমণ্ডি আল বদর ক্যাম্পে চলে আসি। সবাইকে পরিস্থিতি সম্পর্কে সতর্ক করলাম। এর মধ্যেই খবর পেলাম যে মোহাম্মদপুর থানা থেকে একটা গ্রুপ আমাকে গ্রেফতার করতে আসছে। ইমরান ভাই আমাকে বললেন, "আপনি দ্রুত জিপ নিয়ে এখান থেকে বের হোন।" আমি রাজি হচ্ছিলাম না। কারণ এই মুহূর্তে ঢাকাতে আমাদের ১১টি ক্যাম্পে এক হাজারের বেশি আল বদর ক্যাডেট অবস্থান করছে। তাদের না সরিয়ে আমি কিভাবে সরে যেতে পারি! আমার কথা যেন তিনি শুনলেনই না। বাহু ধরে টেনে জোর করে আমাকে জিপে উঠিয়ে ড্রাইভারকে হুকুম দিলেন, "দ্রুত নিয়ে যান।"
আমি চলে আসার পর ওখানে দায়িত্বশীল শুধু ইমরান ভাই ছিলেন। এরই মধ্যে সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে। ইমরান ভাই পুরো দায়িত্বশীলতার সাথে সকল সাথীকে বিভিন্ন দিকে হিজরত করার জন্য পরামর্শ দিয়ে অন্য ক্যাম্পে রওনা হলেন। কিন্তু রাস্তায় একটা দুর্ঘটনায় উনার হাতে মারাত্মক জখম হয়। খুব কাছেই তার বোনের বাড়ি ছিল। কিন্তু দুলাভাই দোশ নওয়াজ 'ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি'র কর্মী। ওখানে আশ্রয় হলো না। তিনি চলে গেলেন হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে। কিন্তু সেটা তার জন্য সুরক্ষিত ছিল না। কারণ তিনি মেডিকেলেরই শিক্ষার্থী ছিলেন। আর এটাই তার কাল হয়ে দাঁড়াল। হাসপাতালের এক কর্মচারী তাকে চিনে ফেলে, খবর চলে যায় দুশমনের কাছে। কুখ্যাত সন্ত্রাসী ও ন্যাপ-সিপিবি-ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা সংগঠক (পরবর্তীতে ড. কামালের নেতৃত্বাধীন গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক) সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিকের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী তাকে তুলে নেয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলে নিয়ে যাওয়া হলো ইমরানকে। ওখানে মৌলবী ফরিদ আহমদ ও ছাত্র সংঘের কর্মী আজিজুল ইসলামের উপর নির্মম নির্যাতন চালানো হচ্ছিল। দুই দিন ইমরান ভাইকে ওখানেই রাখা হলো। এ সময়ে মৌলবী ফরিদ আহমদ শহীদ হন। তার পরনে শুধু একটা গেঞ্জি আর লুঙ্গি ছিল। নামাজের জন্য যখনই পানি চাইতেন, মুক্তি বাহিনী তাকে পেশাব ভরা গ্লাস ধরিয়ে দিত। ১৮ তারিখ দুশমনরা ইমরান ভাইকে প্রথমে টিএসসি নিয়ে যায়। সেখান থেকে আধা ঘন্টা পর জিপে তুলে নিয়ে যায় হাতিরপুল। এখানে মুক্তিবাহিনীর একটা জটলা ছিল। ইতোমধ্যেই চালানো নির্যাতনের কারণে ইমরান ভাইয়ের মাথায় ক্ষত হয়েছিল। মাথায় বাঁধা রুমালটাও তখন ভেজা, রক্তাক্ত। জিপ থেকে নামাতেই আরেক দফা নির্যাতন শুরু হয়। তার কাছ থেকে জেনারেল রাও ফরমান আলীর জারি করা স্পেশাল পরিচয়পত্র পাওয়া যায়। এ যেন দুশমনের নির্মমতার উনুনে আরও আগুন ঢালে। জুলুমের পরিমাণ ও পদ্ধতি আরও বেড়ে গেল এর ফলে।
কিন্তু প্রতিটি আঘাতের জবাবেই ইমরান আরও শক্তি নিয়ে বলে উঠছিলেন 'পাকিস্তান জিন্দাবাদ'। তার মুখ থেকে আল বদর সম্পর্কে কোন তথ্য বের করা গেল না। সন্ত্রাসীরা রাগে, উন্মত্ততায় নরপিশাচে রূপ নিল। ব্লেড দিয়ে জখম করে করে গায়ে লবণ মাখানো হলো। তবুও আমানতের হেফাজত করেছেন ইমরান। নির্যাতনের পরিমাণ এত বেড়ে গেছিল যে যেন তার নিশ্বাস কমে আসছে। অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণ হচ্ছিল, গলা শুকিয়ে হয়তো কাঁটা হয়ে যাচ্ছিল। 'পানি' বলে চিৎকার করে উঠলেন তিনি। তার গলার কম্পিত আওয়াজে শয়তান যেন শান্তি পেল। একজন গ্লাসে পেশাব করে তা ইমরানের মুখের কাছে ধরে। তিনি চোখ খুলেই ধাক্কা দিয়ে গ্লাস ফেলে দিলেন। তার কলুষমুক্ত চোখে গুণ্ডাদের এক নজর দেখে ভয়হীন কণ্ঠে আবার বললেন, "পানি"। শয়তানের হাসিতে তার এই আবদারও মিলিয়ে গেল।
ইমরান ভাই প্রচণ্ড তৃষ্ণায় নিজের বাম হাতের
আঙুল মুখে নিয়ে রক্ত চুষতে লাগলেন। কিন্তু মুহুর্তেই তা ফেলে দিলেন। তার
চোখ এখন বন্ধ হয়ে আসছে। এক মহিয়ান মঞ্জিলের দিকে তিনি সফর করতে যাচ্ছেন।
তার জবান বন্ধ হয়ে আসছে। কিন্তু কোন তথ্যই তিনি দিচ্ছেন না। ফলে প্রমাণিত
হচ্ছিল তার বুক ইসলাম ও পাকিস্তানের মুজাহিদদের গোপনীয়তার দুর্গ। তাই এত
নিপীড়নের পরও তার এত 'সহজ' মৃত্যু সহ্য হচ্ছিল না আধিপত্যবাদী গুন্ডাদের।
তাদের একজন চাকু দিয়ে ইমরানের বুকে 'জয় বাংলা' খোদাই করতে উদ্যত হলো। এই
যন্ত্রণায় ঠোঁট কাঁপতে কাঁপতে শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করলেন মোস্তফা শওকত
ইমরান। আশহাদু আল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ...
কিন্তু ম্রিয়মাণ এই কালেমার
আওয়াজও দুশমনের সহ্য নয়। তার কলেজেরই এক ছাত্রলীগ কর্মী বুকে চাকু দিয়ে
গভীর আঘাত করে দুই হাতে বুক চিরে কলিজা বের করে আনে। ইমরানের অযুত সাহসের
এই তপ্ত লাভা শুধু মাটিতে ফেলেই ক্ষান্ত হয়নি, পায়ের তলায় পিষ্টও করে সেই
আধিপত্যবাদের দোসররা।
ইমরান এভাবে জীবনের বাজি হেরেছেন, কিন্তু ইসলামী
আন্দোলনের গৌরবদীপ্ত পথ ছেড়ে দেননি। তার কর্মীদের আর আন্দোলনের গোপনীয়তা
জীবন দিয়ে রক্ষা করেছেন। দ্বীন প্রতিষ্ঠার কর্মীদের জন্য দুর্গম দুঃসাহসিক
অভিযাত্রায় উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন শহীদ মোস্তফা
শওকত ইমরান। ইসলামের ইতিহাসে ত্যাগ আর কুরবানির যে সিলসিলা, তা রক্ষা করেই
১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর সন্ধ্যা আরও একবার উজ্জ্বল হলো তার রক্তে।" — তৌফিক ইলাহী
[
নির্যাতনের বিস্তারিত তৌফিক ইলাহীকে জানিয়েছেন ইমরানের উপর নির্যাতনে অংশ
নেওয়া মুক্তিবাহিনীর সদস্য ড. জামিল উজ জামান। তিনি আজিমপুরে থাকতেন।
ইমরানের শাহাদাত তাকে ইসলামী আন্দোলনের পথ দেখায়। ]
২.
"১৬ ডিসেম্বর
সকালের ঘটনা। ৯টার সময় হতে পারে। যথারীতি দুই-তিন জায়গায় অপারেশনের
পরিকল্পনা নিয়ে ক্যাম্প থেকে রওনা হতেই যাচ্ছিলাম। তখন পূর্ব পাকিস্তান
ছাত্র সংঘের সভাপতি, ঢাকা সভাপতিসহ মোস্তফা শওকত ইমরান গাড়ি নিয়ে আসলেন।
তিনি তথ্য বিভাগের ইনচার্জ ছিলেন। সাথে আরও দুয়েকজন ছিল। তিনি বললেন, "রাতে
আমরা ভয়েস অব আমেরিকা আর বিবিসিতে শুনেছি যে পাক ফৌজ অস্ত্র সমর্পণ করে
ফেলেছে। চলো, আর্মি হেড কোয়ার্টার থেকে আসল সুরতহাল জেনে আসি।" আমি জবাব দিলাম, আমার কাছে সময় নাই। দুয়েকটা জরুরি কাজ করতে হবে। মনে হচ্ছে অস্ত্র সমর্পণের খবর প্রোপাগান্ডা হবে।
আমার
ধারণা এমনটাই ছিল। কিন্তু তারা আমাকে জবরদস্তি আর্মি হেড কোয়ার্টারে নিয়ে
গেলেন। প্রথমে কর্নেল হিজাযীর সাথে সাক্ষাৎ হলো। উনি বললেন, ভালো হয় আপনারা
ব্রিগেডিয়ার বশির সাহেবের সাথে কথা বলেন।
ব্রিগেডিয়ার বশির সাহেবের
সাথে সাক্ষাৎ হলো। তিনি পাক ফৌজ ও আমাদের মধ্যকার লিয়াজো রক্ষার দায়িত্বে
ছিলেন। উনি বললেন, রাত আটটার মধ্যে সব কিছু জানা যাবে। মোস্তফা শওকত ইমরান
জিজ্ঞাসা করলেন, আপনারা যদি আত্মসমর্পণ করেন তাহলে আমাদের ব্যাপারে কী
ভেবেছেন? তিনি জবাব দিলেন, আপনারা সিভিল ড্রেস পরে সাধারণ মানুষের মধ্যে
মিশে যাবেন। অথবা উর্দি পরে আমাদের সাথে অস্ত্র সমর্পণ করতে পারেন। তারপর
যা আমাদের সাথে হবে, আপনাদের সাথেও তাই হবে। কিন্তু আমার ইচ্ছা, আমাদের
দুর্ভোগ আপনাদের পোহানোর দরকার নাই। আমি তো এখনও এটা বুঝতে পারছি না যে পাক
ফৌজ হিন্দুস্তানিদের সামনে অস্ত্র সমর্পণ করছে!
ইমরান বললেন, আল বদরের
একটা সদস্যও এই বেইজ্জতির জন্য প্রস্তুত না। অন্তত আপনারা যে অস্ত্র
দুশমনের সামনে জমা দিচ্ছেন, সেগুলো আমাদের দিয়ে দেন। আমরা লড়বো। ব্রিগেডিয়ার
সাহেব কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বললেন, আমাদের ক্ষমতাই বা কী! না কোন অর্ডার
দিতে পারি, আর না হাতিয়ার। উপর থেকে যে হুকুম হয় তারই তামিল করতে হয়
আমাদের। এরপর হেডকোয়ার্টার থেকে আমরা চলে আসি।" — আশরাফুজ্জামান
৩.
"শওকত
ইমরান ভাই ছাত্র সংঘের সাথীদের জন্য আপাদমস্তক ইখলাসের উদাহরণ ছিলেন। তার
সাথে দুয়েকটি ঘটনা এখনও স্মৃতিতে আছে। এর একটি — ১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে যখন
দ্বিতীয় দফায় আমাকে কেন্দ্রীয় সভাপতির দায়িত্ব অর্পণ করা হলো, তখন আমার
সমস্যা তিনি কিছুটা বুঝতে পেরেছিলেন। রাত বারোটার দিকে ওষুধ নিয়ে আমার রুমে
চলে আসলেন। যেহেতু উনি ডাক্তার ছিলেন, জানতেন যে আমি মানসিকভাবে পেরেশান
থাকলে আমার ঘুম হয় না। তিনি সম্মেলন কেন্দ্রের ইনচার্জ ছিলেন। কিন্তু সমস্ত
দায়িত্ব পূরণ করার পরও নিজে আরাম করলেন না। আমার খেয়াল না রেখে নিজে
ঘুমানোর প্রস্তুতি নেননি।
বিভিন্ন সম্মেলন বা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোর দায়িত্ব যাদের উপর অর্পিত হতো — শহীদ আব্দুল মালেক, শহীদ শাহ জামাল, শহীদ শওকত ইমরানকে দেখেছি, কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য দিনরাত কাজ করতেন। এত দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়েও মেজাজের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল। সব কাজ নিজে এগিয়ে এসে করতেন। শাহ জামাল ভাই মেঝেতে বসে বসে কাজ করিয়ে নিতেন। কিন্তু আব্দুল মালেক ও শওকত ইমরান সম্মেলন কেন্দ্রের ইনচার্জ কিংবা সম্মেলনের সভাপতি হয়েও ছোট ছোট কাজ নিজে করে ফেলতেন।" — শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী
৪.
শওকত
ইমরান ফেনী শহরে এক বিত্তবান পরিবারে জন্ম নেন। শৈশব থেকেই তিনি নম্র-ভদ্র
হিসাবে বেড়ে উঠেছিলেন। কিন্তু বাবা ছিলেন আওয়ামীলীগ নেতা। ফলে ঘরে রাজনীতি
চর্চা হওয়ায় তখন থেকেই দুর্বার সাহসীও হয়ে ওঠেন শওকত ইমরান। স্কুল জীবন
থেকেই বিভিন্ন বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় অংশ নিতেন। পরবর্তীতে মেডিকেল
শিক্ষার্থী হলেও ইতিহাসের উপর তার অসামান্য দক্ষতা ছিল।
স্কুল জীবনেই ছাত্র সংঘের দাওয়াত পেয়েছিলেন তিনি। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার পর ভর্তি হন ঢাকা মেডিকেল কলেজে। ইচ্ছা ছিল এম.বি.বি.এস করবেন। এখানে এসে ইসলামী ছাত্রসংঘে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ৩০ এপ্রিল ১৯৬৮ সদস্য হওয়ার জন্য আবেদন করেন। চার মাস সদস্য প্রার্থী থাকার পর নভেম্বরে সদস্য হন। ১৯৬৯ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংঘের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। একই বছর প্রথমে প্রাদেশিক শুরা সদস্য এবং পরের বছর কেন্দ্রীয় শুরা সদস্য হিসাবে নির্বাচিত হন তিনি। সর্বশেষ প্রাদেশিক তথ্য শাখার দায়িত্বে ছিলেন। যুদ্ধ চলাকালে ঢাকা আল বদরের তিনটি কোম্পানিতেই তিনি কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
শহীদের পরিবার আওয়ামী রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত থাকায় মাওলানা আবুল আ’লা মওদূদী ও অধ্যাপক গোলাম আযমের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করতেন। বাবা টাকার গরমে ছেলেকে জামায়াতের থেকে কিনেও নিতে চেয়েছিলেন। একবার মোস্তফা শওকত ইমরানকে চিঠি পাঠিয়েছিলেন, "মোস্তফা, মাওলানা মওদূদী তোমাকে কত টাকায় কিনেছে? তুমি যদি মওদূদী আর গোলাম আযমের ক্রীতদাস হয়ে থাকো, তাহলে আমি প্রতিটি উপায়ে তোমাকে মুক্ত করতে চাই। নিজের সমস্ত সম্পত্তি বিক্রি করে, এমনকি নিজের শরীরের চামড়া দিয়ে জুতা বানিয়ে হলেও তোমাকে গোলামী থেকে মুক্ত করতে চাই।"
এসব কারণে শওকত ইমরান পরিবারের চিঠি এড়িয়ে যেতেন। ঘন ঘন বাড়ি যাওয়াও তার পছন্দ ছিল না। তৌফিক ইলাহী চিঠির ব্যাপারটা খেয়াল করে তাকে পড়ার জন্য চাপ দিতে থাকেন। তখন তিনি নিজেই চিঠি খুলে তৌফিক ইলাহীকে পড়তে দেন। উপরোক্ত চিঠি পড়ার পর তৌফিক বুঝতে পারেন পরিস্থিতি। শওকত ইমরান তখন বলেন, "আমি আব্বা-আম্মার সাথে বেয়াদবি করতে চাই না। এ জন্য চিঠি খুলে দেখি না। সবর করি। কারণ, মনে হয় এই চিঠিগুলো আমাকে আব্বা-আম্মার নাফরমানি করাবে। অথবা সরিয়ে দিবে ইসলামী আন্দোলন থেকে।" শাহাদাতের পর মোস্তফা শওকত ইমরানের বাবা ও ছোট ভাই ইসলামী আন্দোলনে যুক্ত হন।
📖 সালিম মানসুর খালিদের 'আল বদর' বই থেকে অনূদিত
মূল পোষ্ট: Facebook
৭১ এ কি ঘটেছিল রাজাকার কারা ছিল - খন্দকার আবুল খায়ের (রহ)
খন্দকার আবুল খায়ের (রহ) এর "৭১ এ কি ঘটেছিল রাজাকার কারা ছিল" বই এর পিডিএফ
খন্দকার আবুল খায়ের (রহ) বাংলাদেশের প্রথিতযশা মরহুম আলেমদের মধ্যে একজন। তিনি তার দরসে কোরআন সিরিজের জন্য বিখ্যাত। তিনি ৪৬ এর কলকাতা দাঙ্গা, পাকিস্তান ভাগ এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের একজন প্রত্যক্ষ সাক্ষী। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি যশোর এলাকায় জামায়াত ইসলামের দায়িত্ব পালন করেছেন। একজন আলেম হওয়ায় তিনি তাফসির মাহফিল করতেন যেহেতু তিনি একাত্তরের প্রত্যক্ষদর্শী জামায়াত নেতা তাই যেখানে যেতেন সেখানেই এই বিষয়ে কিছু প্রশ্নের সম্মুখীন হতে। এই কমন প্রশ্ন গুলোকে একত্রিত করে নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি একটি বই লিখেন। যেটি তার সাওয়াল জওয়াব সিরিজের চতুর্থ খন্ড হিসেবে প্রকাশিত হয়।
“৭১ এ কি ঘটেছিল রাজাকার কারা ছিল” এই বইটি একটি ঐতিহাসিক দলিল। আসলে একাত্তরে জামায়াতে ইসলাম কি করেছিল, তাদের ভুমিকা কেমন ছিল, জামায়াতে ইসলাম বা জামায়াতে ইসলামের নেতৃবৃন্দ উপরে যে অভিযোগগুলো করা হয় এর সত্যতা কতটুকু এই বিষয়গুলো লেখক বইটিতে নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে তুলে ধরা হয়েছে।
বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর এর নতুন কোন সংস্করণ না বাজারে না আসায় বই কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গিয়েছে। আমাকে এক ভাই বলেছেন যে উনি উক্ত প্রকাশনীতে গিয়েও বইটির একটি কপি সংগ্রহ করতে পারেনি। আলহামদুলিল্লাহ আমার কাছে এক কপি ছিল সেই বইটির। আমি বইটির পিডিএফ করেছি আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করার জন্য। আশা করি আপনারা শেয়ার করে বইটি কাছে ছড়িয়ে দেবেন। বর্তমান সময়ে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা ৭১ নিয়ে চিন্তার জায়গায় যে দোলাচলে ভুগছে এই বইটি। তাদের সঠিক পথ দেখাবে বলে আশা করছি।
ডাউনলোড পিডিএফ:
১. Link (Archive)
২. Link (Drive)
হাকেমিয়্যাতঃ মাওলানা মওদূদী [রহ.]
হাকেমিয়্যাতঃ মাওলানা মওদূদী [রহ.]
মাওলানার হাকেমিয়্যাত দর্শন নিয়ে আলোচনার আগে কুরআন থেকে একটা বিষয় দেখে নেয়া জরুরি। কুরআনে মানুষের সফলতা ও মানুষের বিফলতার ২ টি দিক বলা হয়েছে। কয়েকটি আয়াত উল্লেখ করলে তা স্পষ্ট হয়ে যায়।
এক. কারা বিফল?
• আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল কোনো বিষয়ে ফয়সালা দেয়ার পর সে ব্যাপারে কোনো মু’মিন নারী পুরুষের কোনো ক্ষমতা নেই তাঁর বিপরীতে কথা বলার। কথা বললেই সে বিফল অর্থাৎ সে গোমরাহীতে নিমজ্জিত।– আহযাব ৩৬
• যারা বলে আমরা আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের উপর ঈমান এনেছি । এবং আনুগত্য কবুল করেছি। কিন্তু তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়। এরা মু’মিন নয়। নূর ৪৭-৪৮
দুই. কারা সফল?
• যখন তাঁদের মধ্যে ফয়সালা করা হবে আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে এবং এদিকে আহবান করা হবে তখন তারা বলবে, আমরা শুনেছি এবং আনুগত্য করেছি। এটা ঈমানদারদের কাজ। এবং এরাই সফল। - নূর ৫১
যদি উপরের দুটি আয়াত ভালোভাবে খেয়াল করি { আরোও অসংখ্য আয়াত আছে সব আয়াত একসাথে দেয়া সম্ভব নয় বিদায় এই আয়াতগুলো দিয়েই বললাম ।} তাহলে দেখবো যে, পৃথিবীর যেকোনো বিষয়, যেকোনো দিক ও যেকোনো বিভাগ নিয়ে ফয়সালা বা সিদ্ধান্ত দেয়ার একমাত্র মালিক, একমাত্র ক্ষমতাধর ও একমাত্র অথরিটি হলেন আল্লাহ ও তাঁর রাসূল। মাওলানা মওদূদী এটাকে বলেছেন, ‘উর্ধ্বতন আইন’ বা SUPREME LAW . তিনি বলেছেন এই আইন এমন এক নিরঙ্কুশ ক্ষমতাধর যার মোকাবিলায় ঈমানদার ব্যক্তি শুধুই আনুগত্য করবেন।
এই আইনের বিরোধিতাকারীকে বলা হয়েছে কাফের, মুশরেক ,যালেম, গোমরাহী এবং সীমালঙ্ঘনকারী। আর এই আইনের অধীনে ,এই আইনের গণ্ডীতে এবং এই আইনের সীমারেখায় থাকা ব্যক্তিকে বলা হয়েছে ,সফল ,ঈমানদার ও আনুগত্যপরায়ণ।
সুতরাং আমাদের কাছে একথা একেবারেই পরিষ্কার যে, হুকুম দিবার ও প্রভুত্ব ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার আল্লাহ ছাড়া আর কারও নয়। তিনি আদেশ করেছেন সর্বক্ষেত্রে একমাত্র তাঁরই দাসত্ব ও আনুগত্য করতে হবে আর এটাই সঠিক পথ- বাকী সব পথ ও মত বাতিল এবং পরিত্যাজ্য। এই যে, হুকুম দিবার ও ক্ষমতা প্রয়োগ করার একচ্ছত্র মালিক আল্লাহ- এরই নাম হলো ‘’আল্লাহর হাকেমিয়্যাত বা আল্লাহর সার্বভৌমত্ব’’।
‘’হাকেমিয়্যাত’’- শাসন কর্তৃত্ব ,প্রভুত্ব ,একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী,উচ্চতর ক্ষমতা, নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব ও আধিপত্য অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
অনেক বোদ্ধা পণ্ডিত ব্যক্তিত্ব বলে থাকেন যে, মাওলানা মওদূদিই নাকি প্রথম যিনি আল্লাহর সার্বভৌমত্ব বা হাকেমিয়্যাত নিয়ে কথা বলেছেন। এই কথাটা সত্যি নয়। একবিংশ শতাব্দির মুজতাহিদ , আল উস্তাদ আল ইউসুফ আল কারযাবি (আল্লাহ হেফাযতে রাখুন) তাঁর ‘’মিন ফিকহী আদ দাওলাহ ফিল ইসলাম’’ গ্রন্থে বলেছেন যে, ‘’উসুলে ফিকহ শ্রাস্ত্রের ভূমিকায় উসুলবিদগণ শরীয়তের ‘হুকুম’ তথা বিধি-বিধান ,’হাকেম’ তথা আইন প্রণেতা ও ‘’মাহকুম আলাইহি’’ বা শাসিত এবং ‘’মাহকুম বিহি’’ তথা সংবিধান ইত্যাদি বিষয়ের আলচনা করতে গিয়ে ‘হাকেমিয়্যাত’ তথা শাসন কর্তৃত্বের বিষয়টি সম্পর্কেও আলোচনা করেছেন। ইমাম আবু হামিদ আল গাজালী রহ. তাঁর প্রসিদ্ধ কিতাব ‘‘আল মুসতাসফা মিন ইলমিল উসুল’’ গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে ‘হুকুম’ এর আলোচনা করতে গিয়ে বলেন ; হুকুম হচ্ছে মূলত শরিয়াহর প্রণেতার আদেশ। এরপর তিনি বলেন, হাকেমের আলোচনায় একথা সুস্পষ্ট যে, আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউ হুকুম দেয়ার অধিকার রাখেনা।‘’[ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা তত্ত্ব ও প্রয়োগ, ইউসুফ আল কারযাভী ,বিআইআইটি]
মাওলানা মওদূদী রহ. এর ভাষায়,ইসলামে সার্বভৌমত্ব নির্ভেজালভাবে একমাত্র আল্লাহ তা'আলার জন্য। কোরআন মাজীদ তৌহিদের আকিদায় যে ব্যাখ্যা করেছে তার আলোকে মাওলানা বলেন, এক ও অদ্বিতীয় ‘লা শরীক আল্লাহ’ কেবল ধর্মীয় অর্থেই মা'বুদ নয়,বরং রাজনৈতিক এবং আইনগত অর্থের দিক থেকেও তিনি একচ্ছত্র অধিপতি, রাজা, ক্ষমতাবান ও কতৃত্বশীল। তিনিই আল্লাহ যিনি একমাত্র আদেশ-নিষেধের অধিকারী এবং আইন প্রণয়নকারী। আল্লাহ তা'আলার এই সার্বভৌমত্ব কে তিনি "Legal Sovereignty" হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
তিনি বলেন, ইসলাম আল্লাহর এই ‘আইনগত সার্বভৌমত্ব’ ততটাই জোরের সাথে পরিষ্কারভাবে পেশ করে যতটা জোরের সাথে এবং পরিষ্কারভাবে পেশ করে তাঁর ধর্মীয় সার্বভৌমত্বের আকিদা। মাওলানার দৃষ্টিতে আল্লাহর এই দুই ক্ষমতা আল্লাহর উলুহিয়্যাতের অবশ্যম্ভাবী ফল। একটি থেকে অপরটিকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। যদি ধর্মীয় আকিদা কে গ্রহণ করে বা বেশি জোর দিয়ে অপরটিকে অর্থাৎ রাজনৈতিক ও তামুদ্দনিক আকিদা কে কম জোর বা অস্বীকার করা হয় তাহলে তা ‘আল্লাহর উলুহিয়্যাতে’ অস্বীকার করারই নামান্তর।
তাছাড়া তিনি মনে করেন, ‘ইসলাম এরূপ সন্দেহ করার কোনো অবকাশ রাখেনি যে , খোদায়ী কানুন বলতে শুধু প্রাকৃতিক বিধানকে বুঝানো হয়েছে। বরং মানুষ তাঁর নৈতিকতা ও বিবেকবোধ দিয়ে যা অনুভব করে ,সামাজিক জীবনে চাল-চলনের ক্ষেত্রে যে ধরনের নিয়মের মধ্যে দিয়ে তাঁকে চলতে হয়—এর সবকটা জায়গায়ই মানুষ আল্লাহর সেই শরঈ আইন স্বীকার করে নেবে যা তিনি তাঁর নবীদের মাধ্যমে পাঠিয়েছেন।‘ সুতরাং আইন মান্য করা ও সব স্তরে আল্লাহর আইনকে প্রাধান্য দেয়ার নামই আল্লাহর উলুহিয়্যাতে বিশ্বাস করা।
এই যে নিজের স্বাধীন সত্তাকে আল্লাহর অধীনে বিলিয়ে দেয়া, নিজের ইচ্ছা-শক্তি ,চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা, দৃষ্টিভঙ্গি ও আচার-ব্যবহার, কথাবার্তা ইত্যাদিকে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের নিকট বিলিয়ে দেয়া। এরই নাম মাওলানা দিয়েছেন- ইসলাম বা সারেন্ডার (Surrender)। হাকিমিয়্যাহ অর্থাৎ সুপ্রিম আইনের উপরে কোনো বিকল্প আইন হতে পারেনা। সুপ্রিম আইনের মোকেবেলায় একমাত্র সেই আইনের প্রতি শর্তহীন আনুগত্য দেখাতে হয়।
তারপর তিনি মূল সূত্র কোরআনের সাহায্যে পেশ করেন। তিনি বলেন, সমাজের ,রাষ্ট্রের যেসব ক্ষেত্রে তা রাজনৈতিক হোক, কি পররাষ্ট্রনীতির হোক- যুদ্ধক্ষেত্রে হোক-সন্ধি বা চুক্তি,মিছিল বা জন সমাবেশ, ইবাদাত বা দোয়া ,সাংগঠনিক কাজেই হোক আল্লাহ ও তাঁর রাসুল যা ফয়সালা দিয়েছেন সেসব ক্ষেত্রে কোনো মানুষের ফয়সালা করার অধিকার নাই। তিনি এই সূত্রের আইনত রেফারেন্স হিসেবে কোরআনে বর্ণিত এই আয়াতটি গ্রহণ করেছেন।
আল্লাহ বলেন,"আল্লাহ এবং তাঁর রাসুল যখন কোনো ব্যাপারে ফয়সালা করে দেন, তখন কোনো মুমিন পুরুষ এবং কোন মুমিন স্ত্রীলোকের নিজেদের সেই ব্যাপারে ভিন্নরূপ ফয়সালা করার অধিকার নেই। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের অবাধ্যতা করে সে নিশ্চয়ই সুস্পষ্ট গোমরাহীতে লিপ্ত হলো"।
নৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আল্লাহর প্রভুত্বের হিসাব নিকাশের পর এবার মাওলানা বলেন, তাহলে এই পৃথিবীর ভূখন্ডের সার্বভৌমত্ব কার হাতে থাকবে?
• সাবধান! সৃষ্টি তাঁর ,নির্দেশও তাঁরই – সূরা আল আরাফ
• তারা বলে, আমাদেরও কি কোনো ইখতিয়ার আছে? বলো, সমস্ত ইখতিয়ার আল্লাহরই।– সূরা আলে ইমরান
• চোর- নারী পুরুষ উভয়ের হাত কেটে দাও- তুমি কি জান না যে, আসমান জমীনের সব বাদশাহী আল্লাহরই জন্য।– সূরা আল মায়েদা।
• তোমাদের মধ্যে যে মতভেদই হোক না কেন, তাঁর ফয়সালা করা আল্লাহর কাজ।– সূরা আশ শুয়ারা।
• শাসন কর্তৃত্ব আল্লাহ ছাড়া আর কারোর নেই। তাঁর হুকুম- তোমরা তাঁর ছাড়া আর কারোর বন্দেগী করবে না। এটিই সরল সঠিক জীবন পদ্ধতি, কিন্তু অধিকাংশ লোক জানে না। সূরা ইউসুফ।
মাওলানা মওদূদী রহ. সার্বভৌমত্বের আলোচনায় এক পর্যায়ে বলেন, পৃথিবীর কোনো মানুষই আল্লাহর এই সার্বভৌমে অস্বীকার করেনা। কাফের-মুশরেকরাও করতো না। এই কথার অসংখ্য দলিলও কুরআনে রয়েছে। তাহলে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের সাথে মানুষ বা রাষ্ট্রের বিরোধ কোথায়? তিনি বলেন বিশ্বভূবনের মালিক কে- এই প্রশ্নে কোনো বিরোধ নাই। কিন্তু নির্দিষ্ট করে যদি বলা হয় যে, এই ভূখন্ডের মালিক কে? যেমন, বাংলাদেশের মালিক কে? তখনি মূলত বিরোধ শুরু হয়। ইসলামের দৃষ্টিতে নিখিল বিশ্বের মালিক যেমন আল্লাহ-এই বাংলাদেশের মালিকও তেমনি- আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা ।